top of page

মুক্তিকামী ডাকঘর

রবি ঠাকুরের বিখ্যাত নাটক ডাকঘর প্রথমবার পড়েছিলাম শৈশবে। শিশু অমলকে পরম বন্ধু মনে হয়েছিল। ভেবেছিলাম অসুখে আক্রান্ত অমলের মন ছটফটানোর কাহিনী ডাকঘর। বড় হয়ে আবার যখন ডাকঘর পড়ি তখন খুঁজে পাই অন্য অর্থ। যে বয়সেই পড়ি না কেন ‘ডাকঘর’ নতুন নতুন বার্তা হাজির করে। হয়তো ভবিষ্যতে পড়লে আরও নিগূঢ় কিছু পরিষ্কার হবে।


ডাকঘর অতি অল্প পরিসরে জীবনের অনেক দিকের প্রতি আলোকপাত করেছে। প্রতিদিন হুবহু একই জীবন যাপন করতে করতে মনে হয় আমিও অমলের মত একটা ঘরে বন্দী। কিন্তু ডাকঘর আমাদের দেখায় ছোট ছোট বিষয় থেকে ছোট ছোট আনন্দগুলোকে জোড়া দিয়ে নিতে। দই বিক্রির সুর, প্রহরীর ঘণ্টাধ্বনি, পিসির রামায়ণ পড়া, কাঠবিড়ালীর হুটোপুটি, ডাকহরকরার কাজ, শিশুদের খেলা, পথের ধারে পথিকের বিশ্রাম নেওয়া সবকিছুর ভেতরে আনন্দ দেখতে পায় অমল। এমনকি ঘরে থেকে ডাকঘরে মানুষের আনাগোনা দেখতেও তার ভালো লাগে।


কোথায় যেন পড়েছিলামঃ

Two things to learn from a child. Laughing without a cause and always busy doing something.

অমলের মধ্যে তাই বার বার দেখি। ছোট্ট অমল অনেক মহার্ঘ্য জীবনবোধের শিক্ষা দেয়।


অমল তার চারপাশের সব মানুষের সাথেই মেশে। বয়স, পেশা, গোত্র, অর্থ নির্বিশেষে সবাইকে সে আপন করে নিতে চায়। আর যাকে যা-ই করতে দেখে নিজে সেটাই হতে চায়। দইওয়ালাকে দেখে দই বিক্রি করতে চায়, ফকিরকে দেখে ক্রৌঞ্চদ্বীপে যেতে চায়; প্রহরীর ঘন্টা বাজানো, ডাক হরকরার চিঠিবিলি, ফুল কুড়ানো, কাজ খুঁজতে খুঁজতে পাহাড় পেরিয়ে চলে যাওয়া- জগতের হেন কিছু নেই যা সে বাদ দিতে চায়। তবে ঘরে বসে বসে পুঁথি পড়ে পণ্ডিত হওয়াতেই তার যত আপত্তি। সে পৃথিবীর ডাকে বেরিয়ে পড়তে চায়। অমল চিরন্তন এক পৃথিবী–পথিক। পৃথিবীর পথে চলে চলেই সে বিশ্বমানবের সাথে বন্ধুত্ব পাতানোর কথা ভাবে। পাহাড়ের ওপারে কী আছে, আকাশের ওপারে কী আছে, নদী বয়ে চলে কোথায় গিয়ে শেষ হয়, ক্রৌঞ্চদ্বীপে যাওয়ার পথ কোনদিকে- এসবই ভাবে বসে বসে।


রবিবাবু শিশুর সরল মনের সরল কথার ভেতর দিয়ে যা আমাদের জানালেন, তা মনে হয় যেন আমারই মনের কথা, কিন্তু আমি ভাষা দিতে পারি নি তাঁর মত করে। সহজ সরল অমল তার সারল্য দিয়ে সবার হৃদয় হরণ করে। মোড়লের মত বঙ্কিম, বৈষয়িক মানুষও তার সারল্যের বাঁধনে ধরা পড়ে। দইওয়ালা, প্রহরী, সুধা নিজ নিজ কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়। সবার জীবনে স্মৃতির ছায়া ফেলে যায় অমল।


অমলের ঘুমিয়ে পড়া যদিও মৃত্যুর সমার্থক, তবুও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জীবনকে উপভোগ করতে আমাদের শিখিয়ে দেয় শিশু অমল। মৃত্যু যদিও জীবনের শেষ, কিন্তু মৃত্যু জীবনের শেষ কথা নয়। শেষ কথা হচ্ছে, যতদিন বেঁচে থাকা ততদিন জীবনের স্বাদ উপভোগ করা; প্রকৃতি ও মানুষের সাথে মেশা, মানুষের মনে ছাপ ফেলে যাওয়া। যেন কেউ বলে – সুধা তোমাকে ভোলে নি।


ডাকঘর নাটকটি অনেক প্রতীকে আকীর্ণ। যে চিঠির জন্য অমলের ব্যাকুল অপেক্ষা, তা অজানাকে জানার এবং আনন্দের প্রতীক। চিঠির আনন্দকে ধরে আছে ডাকঘর বাড়িটি। ডাকহরকরা বাঁধনহীন আনন্দের দূত। রাজা মহত্ত্ব ও উচ্চতর জীবনের প্রতীক – যাঁর সাথে দেখা করতেই অমলের ঘুম ভাঙবে। অমলের নিদ্রাও তাই হয়ে ওঠে জীবন্মুক্তির প্রকাশ।


অমলের প্রতি মনোভাবের ভিত্তিতে নাটকের চরিত্রগুলোকে কয়েকভাগে ভাগ করা যায়। একদল তাকে আবদ্ধ করে রাখতে চায় ( যেমনঃ করিরাজ ও মোড়ল ), একদল তাকে ভালবাসলেও প্রথার বাইরে যেতে পারে না ( মাধবদত্ত, দইওয়ালা, প্রহরী, সুধা ) আর আরেকদল তাকে মুক্তির পথে নিয়ে যেতে চায় ( ঠাকুরদা ও রাজকবিরাজ ); প্রথমদল প্রথা নির্ধারণকারী ক্ষুদ্র গন্ডীর মানুষ, দ্বিতীয় দল প্রথার জালে আটকা পড়াদের প্রতিনিধি আর তৃতীয় দল প্রথাছিন্ন করে বেরিয়ে আসা জীবনকামী মানুষ। জীবনকে খোঁজার জন্য তারা মরণকে বরণ করে নিতেও কুন্ঠিত নয়।


ডাকঘর নাটকের পরতে পরতে মুক্তির আকাঙ্খা। সংসারের বেড়াজালে নিজেকে আবদ্ধ না করে প্রথাগত জীবনের বাইরে জীবনের খোঁজ অমলের। রাজকবিরাজ দরজা জানালা সব খুলে তাকে মুক্তির প্রথম ধাপে নিয়ে যায়। আর রাজা এসে যখন তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবেন তখন ঘটবে বহুআকাঙ্খিত চিরমুক্তি।


সাধারণ নাটক একটি পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। এর থাকে ক্লাইম্যাক্স স্টেটসহ নানা নাটকীয় পর্যায়। কিন্তু ডাকঘরে আগাগোড়াই একটি প্রশান্তির ছোঁয়া আছে, যা কেবল রবীন্দ্রনাথেই খুঁজে পাওয়া যায়।


মুক্তি আর প্রশান্তির বার্তাবাহী ডাকঘর তাই উচ্চতর জীবনবোধের দিকে আমাদের ডেকে নিয়ে যায়।


Featured Writing
Tag Cloud
No tags yet.
bottom of page