top of page

ছদ্মজীবন

প্রেস ক্লাবের সামনে রাস্তায় জ্যাম থাকায় বাস থেকে নেমে পড়ল মেহেদী। বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে মানববন্ধন করছে। দেখল, অনেকের হাতে ‘নন্দিনীর খুনীদের ফাঁসি চাই’, ‘প্রভাবশালীদের তোয়াজ বন্ধ করো’ ইত্যাদি লেখা প্ল্যাকার্ড আর কাছেই পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। গত কয়েকদিন ধরে সব মাধ্যম নন্দিনীর খুনের প্রতিবাদে সরগরম। জানা গেছে, এক শিল্পপতির আদেশে খুন হয়েছে। চারদিন পরও খুনীরা ধরা না পড়ায় ফেসবুকে মানববন্ধনের ডাক দেওয়া হয়েছে। তবে খবরটা যতটা আলোচিত হয়েছে, মানববন্ধনে ভীড় যেন একটু কমই লাগল মেহেদীর।


একটা টং দোকান থেকে চা নিয়ে একপাশে দাঁড়াল সে। কাছেই দুজন পুলিশ চা খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। মেহেদী কান খাড়া করল।


‘ঐদিন ঢাকা শহরে আরও চাইরটা খুন হইছে। নিউজে এইডারে বেশি ফোকাস করসে। বাকিডির কোন খবর নাই, এইডার বেলায় সবতে মিল্লা বিচার চাই’।


‘এফটিআর গ্রুপের মালিক করাইছে বইলাই তো .... ’


‘এফটিআরের মালিক করসে হেইডা অপরাধ, আর বাকিডি অপরাধ না?’


টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা এসে প্রতিবাদকারীদের প্রতিক্রিয়া নিতে শুরু করলেন। মেহেদী সেদিকে এগিয়ে গেল।


‘আপনারা তো ফেসবুককে জনমত গঠনের একটি বিকল্প মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন, ............’


বুদ্ধিজীবীদর্শন একজন পুরো প্রশ্ন না শুনেই বলতে শুরু করলেন, ‘ফেসবুকে মানুষ জীবনের বহুবিধ প্রকাশের পন্থা খুঁজে পেয়েছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক। যাদের বলার কোন জায়গা ছিল না সেই সাইলেন্ট মেজরিটি তাদের মত প্রকাশের একটা জায়গা পেয়েছে ............’


কাজের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় মেহেদী পল্টনের দিকে এগোল। মোড়েই দেখা হয়ে গেল মাহমুদ ভাইয়ের সাথে। এতদিন কেবল ফেসবুকেই পরিচয় ছিল। আজ প্রথম সামনাসামনি দেখল। মাহমুদ ভাই ফেসবুকের প্রসিদ্ধ সেলিব্রিটি। লাইক-কমেন্টেরা তাঁর স্ট্যাটাসে পঙ্গপালের মত ছুটে আসে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ভূগোল, ক্রিকেট, দেশপ্রেম হেন কোন বিষয় নেই, যা নিয়ে তিনি লেখেন না। উনার মত করে লিখতে পারে না বলে মেহেদীর খানিকটা ঈর্ষাও হয়। নন্দিনীর খুনের বিবরণ এবং কারণ মেহেদী প্রথম জানতে পেরেছিল মাহমুদ ভাইয়ের স্ট্যাটাস থেকেই। মেহেদী পরিচয় দিল। মাহমুদ ভাই প্রথমে চিনতে পারলেন না, তাঁর অনেক অনুসারী। মেহেদী তাঁর সব পোস্টে কমেন্ট-লাইক করে। তাঁর কয়েকটি পোস্টে মেহেদী কী কী মন্তব্য করেছিল তা স্মরণ করিয়ে দেওয়াতে চিনতে পারলেন। দুয়েক কথার পরে জিজ্ঞেস করল, ‘প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন হচ্ছে। আপনি যাবেন না?’


‘হ্যাঁ, যাবো ..... মানে এখন না, আমার আসলে জরুরি কাজ আছে। দাঁড়াও একটা ফোন করে নিই।’


মাহমুদ ভাই অনেকটা সময়ের জন্য ফোনে ব্যস্ত হয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘একটু তাড়া আছে। যাই, কেমন?’


মেহেদী স্পষ্ট বুঝল, মাহমুদ ভাই মানববন্ধন এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই এটা করলেন। মাসখানেক আগে এক মানববন্ধনে পুলিশ লাঠিচার্জও করেছিল। হয়তো ভয় পেয়েছেন তিনি; ভেবেছেন, কী দরকার? অথচ, ফেসবুকে এই মানুষগুলোকে কী উজ্জ্বলই না লাগে! তাঁদের দেখে মনে হয়, এখনো আমাদের দেশে বিবেক মরে যায় নি। ফেসবুকে মানুষ নিজেকে প্রকাশের উপায় যেমন খুঁজে পেয়েছে আবার জনপ্রিয়তামুখীও হয়ে পড়েছে। সহজে প্রশংসা পাওয়ার জন্য একধরণের ছদ্মব্যক্তিত্ব ধারণ করে থাকে লোকজন। ফেসবুকে প্রত্যেকে যে মানুষটি হয়ে থাকে বাস্তবে তার কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করলেই সমাজটা অনেক সুন্দর হয়ে যেত। কেউ কেউ সে চেষ্টা করেও। পুলিশের লাঠিপেটা খেয়েও অনেকে মানববন্ধন করে যায়।


মেহেদী সিদ্ধান্ত বদলে মানববন্ধনে এসে যোগ দেয়। মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকে, যে মৃত্যুগুলো খবরে ঠাঁই পায় নি সেগুলোর প্রতিবাদে তো দাঁড়ানো হয় নি। সে নিজেকে বোঝায়, একটি অন্যায়ের প্রতিবাদ মানেই তো সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান। অন্তত, প্রতিবাদে দাঁড়ানোর অভ্যাসটা তো গড়ে উঠুক।


২২ ডিসেম্বর, ২০১৫ শ্যামলী, ঢাকা।

[ গল্প বিষয়ক মাসিক পত্রিকা গল্পকার'এর জানুয়ারী ২০১৬ সংখ্যায় অণুগল্পটি প্রকাশিত। পত্রিকায় গল্পটির নাম বদলে ফেসবুক ও মুখোশ রাখা হয়েছিল। ]

Comments


Featured Writing
Tag Cloud
No tags yet.
bottom of page