top of page

দোটানা

কিং বিরিয়ানী হাউজের সামনে কর্মচারীরা সারাদিন মন্ত্রের মত উচ্চারণ করতে থাকে – তেহরী, চিকেন বিরানী, কাচ্চি, মোরগ পোলাও, সাদা ভাত। আরও দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কিছুক্ষণ পর পর বিরিয়ানীর ডেকচি আর বড় ঢাকনার সংঘর্ষে বিশেষ একটি শব্দ তৈরি করে। ডেকচির ভেতরের বিরিয়ানীর সুবাস বাতাসে কিছুটা ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ দেয় ঘ্রাণাহূত ক্রেতার আশায়। শব্দ বা সুবাস কোন একটিও যদি ক্রেতাকে প্রলুব্ধ করতে পারে তার জন্যই এ তৎপরতা। কোন পথচারী সামনের পথে চলতে গেলেই কর্মচারীদের চেষ্টা থাকে দোকানে ঢুকিয়ে ফেলার। অবশ্য পথচারীকে দেখেই তিনি কোন অর্থনৈতিক শ্রেণীর তাও বোঝার চেষ্টা করে। একটু ভাল বেশভূষা দেখলে মন্ত্র উচ্চারণের সময় তারা দামী খাবারের নাম নেয়। আর শ্রমজীবী দরিদ্র কাউকে দেখলে স্বল্পদামী খাবারের নামও মন্ত্রে ঠাঁই পায়। পথচারী একবার দোকানে ঢুকে গেলেই কিছু না কিছু তো খেতেই হবে। আর তাতেই শেষ নয়, খেতে শুরু করলে বোরহানী, লাবাঙ, কোমল পানীয় সবই উপযাচক হয়ে পরিবেশনের চেষ্টা করে।


এতটা আকুল হয়ে গ্রাহককে আকৃষ্ট করতে চাওয়ারও কারণ আছে। কিং বিরিয়ানী হাউজের মালিক নিজামউদ্দিন খুব সহজে দোকানটি পায় নি। দুই তলা দোকান নেওয়ার ফলে খরচ একটু বেশিই পড়েছে তার। অথচ দোকানঘরের জায়গাটা মোটেই বড় নয়। গ্রামের জমি বেচে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে, নানা জায়গা থেকে ব্যবসার টাকা জোগাড় করতে হয়েছে। ইউনিভার্সিটি এলাকার এত কাছে দোকানের অনেক চাহিদা। এলাকার রাজনৈতিক নেতার শরণ নিয়ে, মার্কেটের মালিক সমিতিকে টাকা খাইয়ে দোকানটি অন্য কারও পাওয়া থেকে ঠেকিয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় ঠিকমত ধরনা দিয়ে এবং নগদ ঢেলে শেষ পর্যন্ত দোকানটা পেয়েছে নিজামউদ্দিন। পরিচিত অনেকেই এজন্য তাকে ঈর্ষা করে। ভাবে, উপযুক্ত জায়গায় উপযুক্ত রকমের অসাধু মানুষদের ধরে সে অনেক টাকার মালিক হয়ে গেছে। অথচ ঋণের টাকা শোধ, জমি বেচা টাকা পুনরুদ্ধার, কর্মচারীদের বেতন, রাজনৈতিক নেতার ছেলেপুলেদের নিয়মিত চাঁদার টাকা সব নিয়ে তার মাথায় সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা।


তবে নিজামউদ্দিন দোকানকে সাধ্যমত সুন্দর করে সাজিয়েছে। একজন ভাল ইন্টেরিয়র ডিজাইনারকে ধরে চেয়ার টেবিলের সুন্দর ডিজাইন করিয়েছে। দোকানের নাম আর লোগো দিয়ে প্লেট বাটি অর্ডার করিয়ে নিয়েছে। দোতলায় মহিলাদের জন্য সুব্যবস্থা রেখেছে। দোতলায় যাওয়ার লোহার সিঁড়িটিতে সুন্দর রঙ করিয়েছে। সবখানে গ্রাহকেরা ঠিকঠাক সেবা পাচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য সিসি ক্যামেরা বসিয়েছে। কাউন্টারে তার কম্পিউটারের পর্দায় সিসি ক্যামেরার চলমান দৃশ্য দেখা যায়। দোকানের সাইনবোর্ডে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লিখে রেখেছে কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই শীতাতপ যন্ত্র ব্যবহার করে না। ছোট্ট জায়গা, তারই এত ভাড়া। সেখানে এভাবে খরচ বাড়ালে লাভ করতে পারবে না। তবে দোকানের জৌলুশ দেখিয়ে খাবারের দাম একটু বেশি রাখতে ভুল করে নি সে।


গ্রাহক হিসেবে তরুণ তরুণীদের জুটি তাদের প্রধান লক্ষ্য। সাধারণ গ্রাহকদের নিচতলায় বসায়। তরুণ তরুণীরা এলে ‘দোতলায় মহিলাদের জন্য সুব্যবস্থা আছে’ বলে উপরের তলায় চলে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। উপরের তলায় ওয়েটাররা স্বল্পদামী খাবারগুলো পরিবেশন করে না। তরুণীদের সামনে তরুণদের একটা ঠাটবাট রেখে চলতে হয় বলে ওয়েটাররাও সবসময় দামী খাবার গছিয়ে দিতে সচেষ্ট থাকে। সবচেয়ে বিরক্ত হয় তারা কেবল তরুণ ছেলেদের দল আসলে। তারা সস্তা খাবার খায় আর টেবিল দখল করে অনেকক্ষণ পর্যন্ত গল্প করে। তাদের উঠে যেতেও বলা যায় না মারমুখো মেজাজের কারণে। অনেক সময় অন্য টেবিলে বসা তরুণ তরুণীদের বিরক্তও করে। তাদেরও নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে কোন তরুণীর সাথে একান্তে বসতে। কিন্তু সুযোগ হয় না বলে পরশ্রীকাতরতা এসে ভর করে তাদের নিঃসঙ্গ মনে।


এতবড় মহানগর, এত বিশাল তার জনগোষ্ঠী, সবাই ব্যস্ত, কেউ কারও দিকে ফিরে তাকায় না। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই প্রেমহীন, তা না হলে দুজন তরুণ তরুণীকে একসাথে দেখে কেউ দৃষ্টি সংযত করতে পারে না কেন? রাস্তায় পাশাপাশি দুজন হাঁটলে লোকজন যতক্ষণ পারে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখতে থাকে। অল্পবয়সীরা দেখে ঈর্ষায় আর বয়ষ্কদের চোখে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস পীড়াদায়ক। কারণ, সেটা তাদের মনে করিয়ে দেয় হৃত দিনের কথা, প্রবল বাসনা থাকা সত্ত্বেও সমাজের চাপে কতকিছু তারা করে উঠতে পারে নি।


অয়ন আর তানিয়া এই জনারণ্যে নিজেদের জন্যে একটু অবকাশ চায়। পার্কে বা লেকের ধারে কোথাও বসলে দলে দলে ছুটে আসে ভিখিরির দল। তাদের মধ্যে আছে শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের ভিক্ষুক। তরুণ তরুণীরা যখন একসাথে কোথাও বসে তখন যেন কোন অন্যায় সুবিধা ভোগ করছে এমন ভাব করে ভিখিরির দল নিজেদের বখরা বুঝে নিতে আসে। তারা নিজেরা অসহায়, কিন্তু অন্যকে বিব্রত করে অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে কিছু আদায় করতে পিছপা হয় না। ভিক্ষে দিতে আপত্তি না করলেও একের পর এক ভিখিরির যন্ত্রণায় নিজেদের সময়টুকুই পায় না অয়ন-তানিয়া। তাছাড়া পার্কে, লেকের পাড়ে মানুষের ঢলের কারণে সবসময় বসার জায়গাও পাওয়া যায় না। ইদানিং আবার পার্কগুলোতে বড় করে বিজ্ঞপ্তি ঝোলানো থাকে, ‘সন্ধ্যা ৭টার পরে যুবক যুবতীর প্রবেশ অথবা বসা নিষেধ’। ফলে আর সকল তরুণ তরুণীর মত অয়ন−তানিয়াও মাঝে মাঝে কোন একটা রেস্তোঁরায় গিয়ে বসতে চায় যেখানে ‘দোতলায় মহিলাদের জন্য সুব্যবস্থা আছে’। হয়তো একটু একান্ত সময় চায় তারা, হয়তো তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার অবসর চায়, হয়তো মেয়েটির পরিবারের তাকে অন্যত্র পাত্রস্থ করার সম্ভাবনা আছে বলে তারা কোনভাবে সেটাকে এড়িয়ে যাবার পরিকল্পনা করতে চায়, কিংবা হয়তো একটু স্পর্শসান্নিধ্যও চায়।


নিজামউদ্দিন কাউন্টারে বসে অয়ন-তানিয়ার দোতলায় যাওয়া দেখে। তখন একজন গ্রাহক খাওয়া শেষে মূল্য পরিশোধ করছিলেন। নিজামউদ্দিন কাজ স্থগিত রেখে দোতলার লোহার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। সিঁড়িতে ওঠার সময় ঝনঝনে ধাতব শব্দে তার হৃদয়ে উত্তেজনা জাগে। অপেক্ষমান গ্রাহকের ধৈর্য্যচ্যুতি হলে তিনি তাড়া দেন। দ্রুত টাকা ফেরত দিয়ে নিজামউদ্দিন সিসি ক্যামেরার দিকে তাকায়। অয়নও জানে দোতলায় কোন প্রান্তে বসলে সিসি ক্যামেরায় অতটা দেখা যায় না। তারা সেখানে গিয়ে বসলে নিজামউদ্দিন কাউন্টারে বসে কম্পিউটারের পর্দায় নানাভাবে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে।


নিজের উঠতি বয়সে নিজামউদ্দিন কোন নারীর সঙ্গ পায় নি। গ্রামের অত্যন্ত রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েছে সে। জীবনের অস্থির দিনগুলোতে কারও কোলে মাথা রাখতে পারে নি। কোন শঙ্কিতা কিশোরীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে পারে নি, ‘আমি আছি’। তাই উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের দিকে সে বুভুক্ষুর মত তাকিয়ে থাকে। কৌতুহল হয় তার। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো এসব ছেলে মেয়েরা নিজেদের মধ্যে কী করে তা জানতে চায়। সবসময় যে তাদের ঘনিষ্ঠতাকে সমর্থন করে তাও না। জুম্মার নামায শেষে খুতবায় ইমাম সাহেব বলেন, উঠতি ছেলেমেয়েদের বেহায়া মেলামেশায় কী কী সর্বনাশ হচ্ছে - কখনও ভূমিকম্প, কখনও সুনামী বা সাইক্লোনের মাধ্যমে কেয়ামত কাছাকাছি আসার লক্ষ্মণই স্পষ্ট হচ্ছে। তবুও একটু আর্থিক লাভের আশায় নিজের দোকানে এসব হতে দেয় সে।


মুনাফা তাকে তরুণ তরুণীদের সুযোগ করে দিতে প্ররোচিত করে আর ইমামের ব্যাখ্যাত ধর্ম তার মধ্যে জাগায় পাপবোধ। আবহমান ঈশ্বর তাকে দেখায় পরকালে দণ্ডের ভয় আর অভ্যুদয়মান ঈশ্বর, মুনাফা তাকে দেয় প্রলোভন। মুনাফা আর ভয়ের দোলাচলে বিভ্রান্ত নিজামউদ্দিন কিং বিরিয়ানী হাউজের কাউন্টারে বসে পেন্ডুলামের মত দুলতে থাকে।


১৯ জানুয়ারী, ২০১৬ শ্যামলী, ঢাকা।


[ আটচালার একুশে সংখ্যা ২০১৭-তে প্রকাশিত, তারিখ ১৭ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৭, শুক্রবার। ]

Featured Writing
Tag Cloud
No tags yet.
bottom of page