top of page

নিঃস্বার্থ বন্ধু

মূলঃ অস্কার ওয়াইল্ড (The Devoted Friend) নোটঃ অস্কার ওয়াইল্ড চেয়েছিলেন এই গল্পটি শিশুদের পড়ে শোনানো হোক।

গল্পটি অস্কার ওয়াইল্ডের 'দ্য হ্যাপি প্রিন্স অ্যান্ড আদার স্টোরিজ' বইয়ের অন্তর্ভুক্ত

এক সকালে বুড়ো ইঁদুরটি গর্ত থেকে মাথা বের করল। চোখগুলো তার উজ্জ্বল পুঁতির মত, শক্ত ধূসর গোঁফ আর লম্বা কালো রাবারের মত লেজ। কাছেই হাঁসের ছানারা পুকুরে সাঁতরে বেড়াচ্ছিল, তাদের দেখতে লাগছিল হলুদ ক্যানারি পাখির ঝাঁকের মত। তাদের মা ছিল ধবধবে সাদা আর টুকটুকে লাল তার পা। পানিতে কিভাবে মাথায় ভর দিয়ে দাঁড়াতে হয়, মা তাদের সেটাই করে দেখাচ্ছিল।


‘তোমরা যদি মাথায় ভর দিয়ে দাঁড়াতে না শেখ তাহলে কখনোই জাতে উঠতে পারবে না,’ সে বার বার বলতে থাকল এবং করে দেখাতে লাগল। কিন্তু হাঁসের ছানারা তাতে কান দিচ্ছিল না। তারা এতই ছোট যে জাতে ওঠার সুবিধা যে কী তাই বুঝতে পারছিল না।


‘কী অবাধ্য বাচ্চা!’ ইঁদুর চেঁচিয়ে বলল, ‘তাদের ডুবে মরা উচিত।’


‘কখনোই না,’ হাঁস বলল, ‘শুরুতে অমনই হয় আর মা-বাবাকে তো ধৈর্য্য ধরতেই হয়।’


‘মা-বাবার অনুভূতি কেমন আমার জানা নেই,’ ইঁদুর বলল, ‘আমি সংসারী মানুষ নই। আসলে, আমি বিয়ে করি নি, করার ইচ্ছেও নেই। ভালোবাসা যেমনই হোক, বন্ধুত্ব তার চেয়েও বড়। সত্যি বলতে কী, নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের চেয়ে মহৎ বা দুর্লভ কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।’


পাশেই উইলো গাছে বসে সবুজ লিনেট(*) পাখিটি তাদের কথা শুনছিল। সে জিজ্ঞেস করল, ‘নিঃস্বার্থ বন্ধু তবে কী করবে?’


‘হ্যাঁ, আমিও সেটাই জানতে চাইছি,’ বলেই হাঁসটি সাঁতরে পুকুরের ধারে চলে গেল এবং বাচ্চাদের আবারও মাথায় ভর দিয়ে দাঁড়ানোর কৌশল দেখাল।


‘কী বোকার মত প্রশ্ন!’ ইঁদুর অবজ্ঞা নিয়ে বলল, ‘আমি চাই, সে সবসময় আমার প্রতি নিঃস্বার্থ থাকবে, আর কী?’


‘আর প্রতিদানে তুমি কী করবে?’ গাছের ছোট ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে পাখা ঝাপটিয়ে ছোট পাখিটি পালটা জিজ্ঞেস করল।


‘তোমার কথা বুঝলাম না,’ ইঁদুর উত্তর দিল।


‘এই নিয়ে তোমাকে একটা গল্প বলি শোন,’ ছোট পাখিটি বলল।


‘গল্পটা কি আমাকে নিয়ে?’ ইঁদুর জিজ্ঞেস করে, ‘তাহলে শুনব, কাহিনী শুনতে আমার বেশ লাগে।’


‘এটা তোমার জন্য খাটে,’ একথা বলে লিনেট উড়ে এসে পুকুর পাড়ে বসে এক বন্ধুর গল্প শুরু করল।


লিনেট শোনাল, ‘হ্যান্স নামে এক সৎ লোক ছিল।’


‘সে কি খুব মান্যগণ্য ছিল?’ ইঁদুর জিজ্ঞেস করল।


‘না, সে মোটেও মান্যগণ্য ছিল না, কিন্তু তার মনটা ছিল খুব বড়। মুখটা গোলগাল, সবসময় হাশিখুশি। সে একটা ছোট্ট কুটিরে একা থাকত আর নিজের বাগানে কাজ করত। পুরো গ্রামে তার বাগানের মত সুন্দর কোন বাগান ছিল না। সেখানে ফুটত বাহারী ফুল – সুইট উইলিয়াম, গিলি, শেফার্ড’স পার্স, ফ্রান্সের ফেয়ার মেইড। আরো ছিল দামেস্কের গোলাপ, হলুদ গোলাপ, সাদা বেগুনি সোনালী ক্রোকাস, কলম্বাইন, লেডীস’মক, মারজোরাম, বনতুলসী, কাউস্লিপ, ড্যাফোডিল, ক্লোভ পিঙ্ক, সুগন্ধী মশলার গাছ,নানা রঙের লতানো ফুল আর কত বলব! সবসময় বাগানে কলি না হয় ফুল ফুটতেই থাকত, একটি ফুল ঝড়তে না ঝড়তেই আরেকটি তার জায়গা নিয়ে নিত। সারাবছর জুড়ে বাগানটি চোখজুড়ানো রঙ আর মনমাতানো সুরভীতে ভরে থাকত।


লিটল হ্যান্সের অনেক বন্ধু ছিল কিন্তু সবচেয়ে কাছের ছিল তার কল-মালিক (মিলার) বন্ধু বিগ হিউ। মিলার সবসময় হ্যান্সের বাগান থেকে ফুলের তোড়া, গুল্মলতা নিয়ে যেত, আর ফলের মৌসুমে পকেট ভর্তি করে নিত বরই, চেরিফল।


মিলার সবসময় বলত, ‘সত্যিকার বন্ধুদের সবকিছুতেই মিল থাকে।’ হ্যান্স হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাত আর বন্ধুর মহৎ চিন্তায় গর্বিত হত।


প্রতিবেশীরা মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হত যে, মিলারের বস্তা বস্তা মজুদ ময়দা, ছয়টি গাভী আর অনেকগুলো পশমী ভেড়া থাকা সত্ত্বেও হ্যান্সকে সে কখনোই কিছু দেয় নি। হ্যান্সও এগুলোতে মাথা ঘামায় নি। নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব নিয়ে মিলারের সুন্দর সুন্দর কথাগুলো শুনতেই তার যত আনন্দ।


হ্যান্স সারাবছর বাগানে কাজ করত। বসন্ত, গ্রীষ্ম আর শরতে তার বাগান ভরে ছিল। কিন্তু শীতে বাগানে কিছুই ফলে নি বলে তার কাছে বাজারে বিক্রি করার মত কিছু ছিল না। ঠাণ্ডা আর ক্ষুধায় চরম কষ্ট পেতে হয়েছে তাকে। কখনো কখনো শুধু শুকনা নাশপাতি বা বাদাম খেয়েই রাতে শুয়ে পড়তে হয়েছে। সারাটা শীত ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ কেটেছে তার। মিলার একটি বারের জন্যও তার সাথে দেখা করতে আসে নি।


মিলার তার স্ত্রীকে বলত, ‘যতদিন তুষারপাত বন্ধ না হচ্ছে হ্যান্সকে দেখতে যাওয়াটা ঠিক হবে না। মানুষ বিপদে পড়লে তাকে নিজের মত থাকতে দেওয়া উচিত, দেখা করে জ্বালাতন করা উচিত না। বন্ধুত্ব সম্পর্কে আমি অন্তত তাই মনে করি এবং আমি নিশ্চিত, আমার ধারণাটি ঠিক। শীত কেটে যাক, বসন্ত আসলে আমি তাকে দেখতে যাব। তখন সে আমাকে খুশিমনে ঝুড়ি ভর্তি করে সুগন্ধী গোলাপ দিতে পারবে।’


তার স্ত্রী আরামকেদারায় বসেছিল। বলল, ‘অন্যদের ব্যাপারে তুমি খুবই বিবেচক। তোমার মুখে বন্ধুত্বের কথা শুনতেও ভাল লাগে। আমি নিশ্চিত, পাদ্রী নিজেও তোমার মত সুন্দর করে বলতে পারবে না, যদিও সে তিন তলা বাড়িতে থাকে আর সোনার আংটি পড়ে।’


‘কিন্তু আমরা কী হ্যান্সকে এখানে নিয়ে আসতে পারি না?’ মিলারের ছোট ছেলে বলল, ‘দরকার হয় তাকে আমি আমার অর্ধেক খাবার দেব আর আমার সাদা খরগোশগুলোর সাথে খেলতে দেব।’


‘কী বোকা ছেলে!’ মিলার বলে উঠলো, ‘তোমাকে স্কুলে পাঠানোই বৃথা হল। তুমি তো কিছুই শিখলে না। হ্যান্স যদি এখানে এসে আমাদের গরম ঘর, ভাল খাবার আর মদের পিপা দেখে, তাহলে তার হিংসে হবে। হিংসে এত ভয়ংকর, তা যে কারো স্বভাব নষ্ট করে দিতে পারে। আমি কখনো সেটা চাই না। আমি ওর সবচেয়ে ভাল বন্ধু তাই আমি সবসময় খেয়াল রাখবো সে যেন কোনকিছুর লোভে না পড়ে। আর হ্যান্স যদি এখানে আসে, সে আমার কাছ থেকে ময়দা ধার চাইতে পারে। ময়দা আর বন্ধুত্ব আলাদা জিনিস। দেখছো না তাদের বানানই কত আলাদা! যে কেউ বুঝবে।’


‘কী সুন্দর করে কথা বল তুমি!’ গলায় উষ্ণকারক পানীয় ঢেলে মিলারের বউ বলল, ‘‘সত্যি আমি আবিষ্ট হচ্ছি। মনে হচ্ছে গীর্জায় আছি।’


‘কাজ অনেকেই ভাল করে,’ মিলার বলল, ‘কিন্তু খুব কম লোকেই ভাল কথা বলতে পারে। তাতে বোঝা যায়, ভাল বলাটাই আসলে কঠিন।’ সে কঠোর দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকায়। ছেলেটি লজ্জায় লাল হয়ে মাথা হেঁট করে বসেছিল। তার চোখের জল গড়িয়ে চায়ে পড়ছিল। যা হোক, সে ছোট মানুষ, তাকে ক্ষমা করা উচিত।


‘গল্পটা কি এখানেই শেষ?’ ইঁদুর জিজ্ঞেস করল।


‘মোটেই না, সবে তো শুরু,’ লিনেট বলল।


‘তাহলে তো তুমি যুগের চেয়ে পিছিয়ে আছো,’ ইঁদুর বলল, ‘আজকালকার সব ভাল গল্পকার গল্পের শেষটা দিয়ে শুরু করে, তারপর শুরুতে যায় আর মাঝেরটা দিয়ে শেষ করে। এটাই নতুন নিয়ম। এক সমালোচক সেদিন পুকুরপাড়ে এক তরুণকে বলছিলেন কথাটা। নীল চশমা পরা টাকমাথার সেই সমালোচক এ বিষয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেছিলেন। আমারও মনে হল, তাঁর কথাই ঠিক। আর যখনই তরুণটি কিছু বলতে চাইছিল, তিনি বলছিলেন, ‘ধ্যাৎ!’ যা হোক, তোমার গল্প চালিয়ে যাও। মিলারকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। আমি খুব ভাবপ্রবণ মানুষ, তাই আমাদের মধ্যে অনেক মিল পাচ্ছি।’


‘বেশ,’ এক পা থেকে আরেক পায়ে ভর বদলে লিনেট আবার শুরু করল, ‘শীত শেষ হতেই যখন বাসন্তী ফুলগুলোর পাঁপড়ি মেলছিল, মিলার তার স্ত্রীকে বলল, সে হ্যান্সের সাথে দেখা করতে যাবে।’


তার স্ত্রী উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, ‘তোমার মনটা অনেক বড়। সবসময় অন্যের কথা ভাবো। মনে করে বড় ঝুড়িটায় ভরে ফুল নিয়ে এসো।’


মিলার বায়ুকলের পাখাগুলো শক্ত লোহার শিকলে বাঁধল। তারপর কাঁধে ঝুড়িটি নিয়ে পাহাড়ের গোড়ায় হ্যান্সের সাথে দেখা করতে গেল।


‘শুভ সকাল, লিটল হ্যান্স,’ মিলার বলল।


কোদালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রসারিত হেসে হ্যান্স বলল, ‘শুভ সকাল।’


‘শীতটা কেমন গেল তোমার?’ মিলার জানতে চাইল।


হ্যান্স বলল, ‘জিজ্ঞেস করে ভাল করেছ। আমার খুব কঠিন সময় গেছে। কিন্তু এখন বসন্ত আসায় আমি খুশী। আমার ফুলেরাও তাই।’


‘শীতের সময় আমরা প্রায়ই তোমার কথা বলতাম,’ মিলার বলল, ‘ভাবতাম কেমন করে দিন কাটছে তোমার!’


‘তোমার অনেক দয়া,’ হ্যান্স বলল, ‘আমি তো ভয়েই ছিলাম যে তুমি আমায় ভুলে গেলে কি না।’


‘হ্যান্স, অবাক করলে আমায়,’ মিলার বলল, ‘বন্ধুত্ব ভোলার জিনিস নয়, এজন্যই তা সুন্দর। কিন্তু মনে হচ্ছে, তুমি জীবনের সেই কাব্যময়তা বুঝতে পারো না। যা হোক, তোমার বাসন্তী ফুলগুলো তো দারুন দেখতে!’


‘আসলেই সুন্দর,’ হ্যান্স বলল, ‘আমার ভাগ্য ভাল যে ফুলগুলো ফুটেছেও প্রচুর। আমি এগুলো বাজারে নিয়ে পৌরপ্রধানের মেয়ের কাছে বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে আমার এক চাকার ঠেলাগাড়িটা কিনে নিয়ে আসব।’


‘তোমার ঠেলাগাড়িটা কিনে আনবে? তুমি কি ওটা বেচে দিয়েছো? কী বোকার মত কাজ করেছ!’


‘আসলে বাধ্য হয়ে করেছি,’ হ্যান্স বলল, ‘দেখো, শীতটা খুব খারাপ গেছে আমার। রুটি কেনার টাকা ছিল না। তাই প্রথমে আমার কোটের রূপার বোতাম বেচলাম, তারপর একে একে রূপার চেইন, বড় পাইপ, ঠেলাগাড়ি সব বেচে দিলাম। কিন্তু এখন আমি সবগুলোই আবার কিনে নেব।’


‘হ্যান্স, তোমাকে আমি আমার ঠেলাগাড়িটা দেব। যদিও ওটার অবস্থা তেমন ভাল না, একটা পাশ নষ্ট হয়ে আছে আর চাকার দণ্ডটাতেও সমস্যা আছে, কিন্তু তবুও আমি ওটা তোমাকে দেব। আমি মন খোলা মানুষ। এটা দিয়ে দেওয়ার কারণে অনেকেই আমাকে বোকা ভাবতে পারে, কিন্তু আমি অন্যদের মত না। আমি মনে করি, বন্ধুর জন্য এটুকু করাই যায়। তাছাড়া আমি আমার জন্য নতুন একটি ঠেলাগাড়ি নিয়েছি। তাই তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো, আমি তোমাকে আমার ঠেলাগাড়িটা দিচ্ছি।’


‘আসলেই তুমি অনেক উদার,’ খুশিতে তার গোলগাল মুখটি উজ্জ্বল হয়ে গেল, ‘আমি সহজেই ওটাকে মেরামত করে নিতে পারব, আমার ঘরে একটা কাঠের তক্তা আছে।’


‘কাঠের তক্তা,’ মিলার বলল, ‘আরে, এটা তো আমার গোলাঘরের ছাদ সারাতে কাজে লাগবে। গোলাঘরের ছাদে বড় একটা ফুটো আছে, যেটা না সারালে শস্যগুলো স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যাবে। এটার কথা বলে ভাল করেছ। দ্যাখো কিভাবে একটা ভালো কাজ আরেকটা ভালো কাজের জন্ম দেয়। আমি তোমাকে আমার ঠেলাগাড়িটা দিচ্ছি আর তুমি আমাকে কাঠের তক্তাটা দিচ্ছ। যদিও ঠেলাগাড়িটা তক্তার চেয়েও দামি, কিন্তু সত্যিকার বন্ধু কখনোই এসব খেয়াল করে না। এখনি ওটা নিয়ে এসো, আমি আজই গোলাঘরে কাজ শুরু করে দেবো।’


‘অবশ্যই,’ হ্যান্স উচ্ছ্বসিত হয়ে ভিতরে গিয়ে তক্তাটা নিয়ে এল।


‘তক্তাটাতো খুব বড় নয়,’ মিলার দেখে বলল, ‘আমার ছাদ সারাইয়ের পর তোমার ঠেলাগাড়ি সারানো সম্ভব হবে না। কিন্তু এটাতো আমার দোষ নয়। যেহেতু আমি তোমাকে আমার ঠেলেগাড়িটা দিচ্ছি, পরিবর্তে তুমি আমাকে কিছু ফুল দেবে। এই নাও ঝুড়ি, পুরোটা ভরে দিও কিন্তু।’


‘পুরোটা?’ হ্যান্স একটু চিন্তিত হল। কারণ ঝুড়িটা অনেক বড়। পুরোটা ভরে দিতে গেলে আর কোন ফুল সে বাজারে বিক্রি করতে পারবে না। সে আসলে তার রূপার বোতামগুলো কেনার কথা ভেবেছিল।


মিলার বলল, ‘যেহেতু তোমাকে আমার ঠেলাগাড়িটা দিচ্ছি আমার মনে হয় না কিছুটা ফুল তার তুলনায় খুব বেশি। আমি ভুলও হতে পারি, কিন্তু আমি জানতাম সত্যিকার বন্ধুত্বে কোনধরণের স্বার্থপরতা থাকে না।’


‘বন্ধু আমার,’ বিচলিত হয়ে হ্যান্স বলে উঠল, ‘তুমি চাইলে আমার বাগানের সব ফুলই নিতে পারো। আমার রূপার বোতামের চেয়েও তোমার অভিমত আমার কাছে বেশি দামি।’


কাঁধে কাঠের তক্তা আর হাতে ফুলের ঝুড়ি নিয়ে যেতে যেতে হ্যান্সকে বিদায় জানাল মিলার। তাকে বিদায় জানিয়ে হ্যান্সও খুশিমনে কাজ করতে লাগল। ঠেলাগাড়িটা পাওয়ার আশায় সে খুব সন্তুষ্ট ছিল।


পরদিন হ্যান্স কিছু লতানো গাছকে পেরেক দিয়ে আটকে রাখছিল, তখন রাস্তা থেকে মিলারের কন্ঠস্বর শুনতে পেল। সে মই থেকে নেমে দৌড়ে বাগানে গিয়ে দেখে, মিলার বড় একটা ময়দার বস্তা পিঠে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।


মিলার বলল, ‘হ্যান্স, তুমি কি আমার হয়ে এই ময়দার বস্তাটা বাজারে নিয়ে যাবে?’


‘আমি খুব দুঃখিত,’ হ্যান্স বলল, ‘‘আজ আমি সত্যি খুব ব্যস্ত। আমার সব লতানো গাছকে পেরেক দিয়ে রাখতে হবে, ফুলে পানি দিতে হবে, ঘাসগুলোকে গুটিয়ে রাখতে হবে।’


‘তাই,’ মিলার বলল, ‘যেহেতু আমি তোমাকে আমার ঠেলাগাড়িটা দিচ্ছি, তাই আমার মনে হয় আমাকে প্রত্যাখ্যান করাটা ঠিক বন্ধুত্বের পরিচয় নয়।’


‘ওভাবে বলো না,’ হ্যান্স বলে উঠল, ‘আমি সারা পৃথিবীর বদলেও তোমার বন্ধুত্ব হারাতে চাই না।’ সে দৌড়ে গিয়ে নিজের টুপি নিয়ে আসল। তারপর ভারি বস্তাটা কাঁধে নিয়ে ক্লান্ত পায়ে টেনে টেনে চলতে লাগল।


সেদিন ছিল খুব গরম আর রাস্তাটাও সাংঘাতিক ধূলিময়। বস্তাটা নিয়ে ছয় মাইল চলার পর সে এত ক্লান্ত হল যে, তাকে থেমে বিশ্রাম নিতে হল। যা হোক, সে সাহসে ভর করে এগিয়ে গেল এবং বাজারে পৌঁছাল। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, খুব ভাল দামে বস্তার ময়দা বিক্রি করল। তারপর খুব দ্রুত ফিরে এল, কারণ, দেরি হলে ডাকাতির আশঙ্কা ছিল।


‘খুব কষ্টের একটা দিন গেল,’ রাতে শুয়ে পড়তে পড়তে হ্যান্স নিজের মনে বলল, ‘তবু আমি খুশি যে মিলারকে না বলি নি। ও আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু, তাছাড়া ও আমাকে ওর ঠেলাগাড়িটা দেবে বলেছে।’


পরদিন সকাল সকাল মিলার ময়দা বিক্রির টাকা নিতে হাজির হল। হ্যান্স এত ক্লান্ত ছিল যে সে তখনও ঘুমোচ্ছিল।


মিলার বলল, ‘তুমি তো ভারি অলস। আমি যে তোমাকে আমার ঠেলাগাড়িটা দেব, সেটা বিবেচনা করলেও তো তোমার আরও কর্মঠ হওয়া উচিত। অলসতা মহাপাপ আর আমার কোন বন্ধু অলস হলে আমি মোটেও পছন্দ করি না। আমার সোজাসাপ্টা কথায় কিছু মনে করো না। আমি তোমার বন্ধু না হলে কখনোই এভাবে বলতাম না। যেটা বলতে চাই, সেটা বলতে না পারলে ভাল বন্ধুত্বের মূল্য কী? মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে যে কেউ খুশি করতে পারে, কিন্তু সত্যিকার বন্ধু সবসময় অপ্রিয় সত্যটাই বলে। বন্ধুর কষ্ট লাগলেও তাতেই তার মঙ্গল হয়।’


‘আমি খুব দুঃখিত,’ চোখ রগড়াতে রগড়াতে রাতের টুপিটা খুলে হ্যান্স বলল, ‘আমার এত ক্লান্তি লাগছিল যে, ভাবলাম আরেকটু শুয়ে থেকে পাখির গান শুনি। জানো, পাখির গান শোনার পর আমি সবসময় কাজ ভাল করি?’


‘বেশ, জেনে ভাল লাগল,’ হ্যান্সকে পিঠ চাপড়ে দিয়ে মিলার বলল, ‘তাড়াতাড়ি পোশাক পরে আমার ওখানে এসো, আমার গোলাঘরের ছাদটা মেরামত করতে হবে।’


হ্যান্স তার বাগানের জন্য উদ্বিগ্ন ছিল, তার ফুলগুলোতে দুদিন ধরে পানি দেওয়া হয় নি। কিন্তু মিলার তার এত ভাল বন্ধু যে তাকে না বলতে ইচ্ছে হল না।


‘আমি যদি বলি আমি একটু ব্যস্ত তাহলে কী সেটা খারাপ শোনাবে?’ কিছুটা লজ্জা আর ভয়মিশ্রিত কন্ঠে সে জিজ্ঞেস করল।


‘আমি যে তোমাকে আমার ঠেলাগাড়িটা দিচ্ছি, সেটা মাথায় রাখলে আমার মনে হয় না আমি বেশি কিছু চেয়েছি। কিন্তু তুমি যেতে না চাইলে আমি নিজেই গিয়ে করে ফেলব।’


‘ওহ, কোনমতেই না,’ হ্যান্স বিচলিত হয়ে বলে উঠল। সে দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে পোশাক পরে মিলারের গোলাঘরের দিকে রওয়ানা দিল।


সে সারাদিন সেখানে কাজ করল। সূর্যাস্তের সময় মিলার তার কাজ দেখতে এল।


‘তুমি কি ছিদ্রটা ঠিক করে ফেলেছো, হ্যান্স?’ উৎফুল্ল কন্ঠে চিৎকার করে মিলার জিজ্ঞেস করল।


‘পুরোটাই হয়ে গেছে,’ মই বেয়ে নেমে আসতে আসতে হ্যান্স বলল।


‘অন্যের জন্য করা কাজের চেয়ে মহৎ কিছুই নয়,’ মিলার বলল।


‘তোমার কথা শুনতে পারাও ভাগ্যের ব্যাপার,’ বসে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে হ্যান্স বলল, ‘আমি মনে হয় কখনই এত সুন্দর করে ভাবতে পারব না।’


‘তুমি নিজেও তা পারবে,’ মিলার বলল, ‘কিন্তু আগে তোমাকে কষ্ট করতে হবে। এখন তোমাকে শুধু বন্ধুত্বের চর্চাটাই করতে হবে, একদিন তুমি এর তত্ত্বটাও বুঝতে পারবে।’


‘তোমার সত্যিই মনে হয় আমি পারব?’ হ্যান্স জিজ্ঞেস করল।


‘আমার কোন সন্দেহ নেই তাতে,’ মিলার বলল; ‘আজ যেহেতু ছাদটা মেরামত করেছ, এখন বাসায় গিয়ে বিশ্রাম কর। কারণ, কাল তোমাকে আমার ভেড়াগুলোকে পাহাড়ে নিয়ে যেতে হবে।’


বেচারা হ্যান্স সংকোচে কিছু বলতে পারল না। পরদিন সকালে মিলার তার ভেড়া নিয়ে হাজির হল আর হ্যান্স তাদের নিয়ে পাহাড়ে গেল। সেখানে যেতে আসতেই তার পুরো দিন চলে গেল। তাই যখন সে ফিরে আসল তখন এত ক্লান্ত ছিল যে, সে চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়ল এবং পরদিন অনেক বেলা করে জেগে উঠল।


‘এখন বাগানে কী সুন্দর সময়ই না কাটবে আমার,’ এই ভেবে সে সাথে সাথে কাজে লেগে গেল।


কিন্তু সে কোনভাবেই তার ফুলগুলোর যত্ন নিতে পারত না। কারণ তার বন্ধু মিলার যখন তখন এসে লম্বা সময়ের জন্য তাকে নানা কাজে পাঠিয়ে দিত বা তার কলে সাহায্যের জন্য নিয়ে যেত। হ্যান্সের মাঝে মাঝেই দুঃখ হত, মনে হত তার ফুলেরা ভাববে সে তাদের ভুলে গেছে। কিন্তু মিলার তার সবচেয়ে ভাল বন্ধু, এই বলে সে নিজেকে প্রবোধ দিত। ‘তাছাড়া,’ সে ভাবত, ‘ও আমাকে ওর ঠেলাগাড়িটা দেবে আর এটা তার বড় মনের পরিচয়।’


এভাবে হ্যান্স মিলারের জন্য কাজ করে যেত আর মিলার বন্ধুত্ব নিয়ে সুন্দর সুন্দর সব কথা বলত। হ্যান্স সেগুলো একটা খাতায় লিখে রাখত আর রাতের বেলায় পড়ত। কারণ, মিলারকে সে খুব জ্ঞানী মানত।


এক সন্ধ্যায় হ্যান্স ঘরে আগুনের পাশে বসে ছিল। তখনই দরজায় জোরে জোরে খটখটানোর শব্দ হল। রাতটা ছিল ভয়ংকর, বাতাস এত শোঁ শোঁ করে বইছিল যে প্রথমে সে ভাবল, ঝড়ের কারণে শব্দ হচ্ছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার শব্দ হল, তারপর তৃতীয়বার, আগের দুবারের চেয়ে জোরে।


‘বোধহয় কোন দুর্ভাগা পথিক,’ হ্যান্স ভাবল এবং দরজায় ছুটে গেল।


দেখে মিলার এক হাতে লণ্ঠন আর আরেক হাতে বড় একটা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।


‘বন্ধু হ্যান্স,’ চিৎকার করে মিলার বলল, ‘বড় বিপদে পড়েছি। আমার ছোট ছেলেটা মই থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তিনি অনেক দূরে থাকেন আর এমন ঝড়ের রাত, হঠাৎই মনে হল, আমার বদলে তুমি গেলেই ভাল হয়। তুমি তো জানো, তোমাকে আমি আমার ঠেলাগাড়িটা দেব, তাই আমার জন্য এটুকু তোমার করাই উচিত।


‘নিশ্চয়ই,’ হ্যান্স জোর দিয়ে বলল, ‘তুমি আমার কাছেই এসেছো বলে আমি খুশি হয়েছি। আমি এখনই রওয়ানা হচ্ছি। তোমার লণ্ঠনটা আমাকে দাও, বাইরে এত অন্ধকার যে খাদে পড়ে যেতে পারি।’


‘দুঃখিত,’ মিলার জবাব দিল, ‘এটা আমার নতুন লণ্ঠন, এটার কিছু হলে আমার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।’


‘বেশ, যা হোক, আমি ওটা ছাড়াই যাচ্ছি,’ বলেই হ্যান্স তার গরম কোট, টুপি আর গলার মাফলার নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।


সাংঘাতিক ঝড় হচ্ছিল! এত অন্ধকার ছিল যে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না আর বাতাস এত প্রবল যে দাঁড়ানোই মুশকিল হচ্ছিল। তবু সে সাহসের সাথে এগিয়ে চলছিল। এভাবে প্রায় তিন ঘন্টা চলার পর ডাক্তারের বাড়িতে পৌঁছে সে দরজায় ধাক্কা দিল।


‘কে ওখানে?’ শোয়ার ঘরের জানালা দিয়ে মাথা বের করে ডাক্তার চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন।


‘হ্যান্স, ডাক্তার।’


‘কি হয়েছে, হ্যান্স?’


‘মিলারের ছেলে মই থেকে পড়ে ব্যথা পেয়েছে, তাই মিলার আপনাকে এখনই নিয়ে যেতে বলেছে।’


‘ঠিক আছে,’ বললেন ডাক্তার। তারপর বুটজুতা, লণ্ঠন নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে মিলারের বাড়ির দিকে চলে গেলেন। হ্যান্স ক্লান্ত পায়ে টেনে টেনে তাঁকে অনুসরণ করছিল।


কিন্তু ঝড় বাড়তেই থাকল, সাথে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হল। হ্যান্স কোন পথে যাচ্ছে তার আর খেয়াল রইল না, ঘোড়ার সাথে তাল মেলাতেও পারল না। শেষে পথ হারিয়ে অচেনা প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। জায়গাটা খুব বিপজ্জনক ছিল, অনেক গভীর গর্তে ভরা। সেখানে বেচারা হ্যান্স ডুবে যায়। পরদিন কয়েকজন ছাগলপালক পানিতে তার লাশ ভাসতে দেখে। তারা লাশটা তুলে তার কুটিরে নিয়ে আসে। হ্যান্সকে সবাই খুব পছন্দ করত বলে সবাই তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় এসেছিল। আর মিলার হয় তার মুখ্য শবানুগমনকারী(**)।


‘যেহেতু আমি তার সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিলাম, তাই আমারই সবচেয়ে ভাল স্থানটি পাওয়া উচিত,’ মিলার বলে এবং লাশবাহী মিছিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার পরনে ছিল দীর্ঘ কালো আলখাল্লা আর কিছুক্ষণ পর পর রূমাল বের করে চোখ মুছছিল।


অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শেষে সবাই সরাইখানায় বসে মশলাদার মদ আর কেক খাচ্ছিল। কামার বলল, ‘হ্যান্সের মৃত্যু প্রত্যেকের জন্য একটা অপূরণীয় ক্ষতি।’


‘আমার জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে,’ মিলার বলল, ‘ভালয় ভালয় তাকে আমার ঠেলাগাড়িটা দিলেই পারতাম, এখন ওটা নিয়ে কী করব বুঝতে পারছি না। আমার বাড়ির পথে পড়ে আছে ওটা। খুব খারাপ অবস্থা, বেচলেও কিছু পাওয়া যাবে না। এ জীবনে আমি আর কখনও ভুলোমনা হব না। উদার হতে হলে কষ্টই পেতে হয়।’


অনেকক্ষণ বিরতির পর ইঁদুর বলল, ‘তারপর?’


‘এটাই শেষ,’ লিনেট উত্তর দিল।


‘কিন্তু মিলারের কী হল?’ ইঁদুর জিজ্ঞেস করল।


‘ওহ, আমি সত্যি জানি না,’ লিনেট উত্তর দিল, ‘সত্যি বলতে কী, আমি পরোয়াও করি না।’


‘এটাই প্রমাণ করে, তোমার স্বভাবের মধ্যে সমবেদনা নেই,’ ইঁদুর বলল।


‘আমার মনে হচ্ছে তুমি গল্পের উপদেশটাই ধরতে পারো নি,’ লিনেট মন্তব্য করল।


‘কী ধরতে পারি নি?’ ইঁদুর চেঁচিয়ে ওঠে।


‘উপদেশ ধরতে পারো নি।’


‘তুমি কী বলতে চাইছো গল্পটার একটা উপদেশও আছে?’


‘অবশ্যই।’


ইঁদুর রেগে মেগে বলল, ‘এটা তোমার আগেই বলা উচিত ছিল, তাহলে আমি গল্পটা শুনতামই না। আসলে আমি তখন ঐ সমালোচকের মতই বলতাম ‘ধ্যেৎ’। যাহোক আমি এখনও বলতে পারি।’ ইঁদুর তারস্বরে ‘ধ্যেৎ’ বলে চেঁচিয়ে উঠে লেজ ঘুরিয়ে তার গর্তে চলে গেল।


‘আর তোমার ইঁদুরকে কেমন লাগল?’ কিছুক্ষণ সাঁতরে এসে হাঁস জিজ্ঞেস করল। ‘ওর অনেকগুলো দিকই ভালো, কিন্তু একজন মা হিসেবে বলতে পারি, একটা চিরকুমারকে আমি করুণা ছাড়া অন্য কোন দৃষ্টিতে দেখতে পারি না।’


‘আমার মনে হয় আমি ওকে একটা উপদেশওয়ালা গল্প বলে বিরক্তই করে ফেলেছি,’ লিনেট উত্তর দিল।


‘ও, এটা সবসময়ই একটা বিপজ্জনক কাজ,’ হাঁস বলল।


এবং আমি তার সাথে পুরোপুরি একমত।

-----------------------------------------------------------------------

(*) লিনেট – একধরণের ইউরোপীয় পাখি, চড়ুইয়ের মত দেখতে।

(**)মুখ্য শবানুগমনকারী – অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অনুষ্ঠানে মৃতব্যক্তির নিকট কোন ব্যক্তি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

[ ছোট কাগজ ‘বিহঙ্গকাল’এর ‘ভাদ্র ১৪২২’ সংখ্যায় প্রকাশিত। সেখানে এর শিরোনাম ছিল – অন্তরঙ্গ বন্ধু ]


Featured Writing
Tag Cloud
No tags yet.
bottom of page