ছোট লাল মুরগী
- tuhintalukder
- May 21, 2016
- 4 min read

গোলাঘরের সামনের উঠানে একটা ছোট লাল মুরগী থাকত। সারাটি দিন উঠানে হেলেদুলে বেড়াত আর খুঁটে খুঁটে পোকা খেত।
বড় বড় পোকা পেলে সে বেশি খুশি হত। ওগুলো খেতেও বেশ আর পুষ্টিকর। বড় কোন পোকা পেলেই কক-কক-কক শব্দ করে ছানাদের ডাকত। ছানাদের শরীরের গঠনের জন্য ভাল করে খাওয়াটা জরুরি।
গোলাঘরের দরজায় একটা বিড়াল পড়ে পড়ে ঘুমাত। সে এত অলস ছিল যে, তার চারপাশে দৌড়ে বেড়ানো ইঁদুরটাকেও ধরার চেষ্টা করত না। খোঁয়ারের শূকরটারও খাওয়া আর মোটা হওয়া ছাড়া দিন দুনিয়ার কোন খবর ছিল না।
একদিন লাল মুরগীটি কিছু গমের দানা পেল। সে জানত না ওগুলো কী। প্রথমে ওগুলোকে নতুন কোন পোকা ভেবে বসল। অবশ্য বড় বড় গমের দানা দেখে এই ভুল হতেই পারে। সে ভাবল এগুলো নিশ্চয়ই খুব সুস্বাদু হবে। একটা দানায় ঠোকর দিয়েই সে বুঝল এগুলো আর যাই হোক, পোকা নয়।
দানাগুলো সংগ্রহ করে সে ঘরে নিয়ে গেল। একে ওকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, এগুলো গমের দানা। মাটিতে রোপন করলে এগুলো থেকে চারা গজাবে। চারা বড় হলে তা থেকে আরও গম পাওয়া যাবে। গম থেকে ময়দা হয় আর ময়দা থেকে রুটি।
মুরগীটি মনে মনে ভাবল, গমের বীজগুলো বুনতে পারলে বেশ হত। কিন্তু তার ছানারা বেশ ছোট। সে সারাদিন নিজের আর ছানাদের খাবার খুঁজতে ব্যস্ত থাকে। এত কিছু করে সে কি বীজ রোপনের আর ফসল ফলানোর সময় পাবে?
সাথে সাথে তার গোলাঘরের শূকর, বিড়াল আর বড় ইঁদুরটার কথা মনে হল। শূকরটা সারাদিন শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয়, তার তো সময়ই কাটবার কথা না। বিড়ালটারও ঘুমানো ছাড়া করার কিছু নেই। আর মোটা ইঁদুরটার তো আলসেমী করেই সময় যায়। তাই সে চিৎকার করে সবাইকে জিজ্ঞেস করলঃ
‘তোমাদের মধ্যে গমের চারাগুলো কে রোপন করবে?’
শূকর বলল, ‘আমি না’, বিড়াল বলল, ‘আমি না’, ইঁদুরও বলল, ‘আমি না’।
‘ঠিক আছে তাহলে’, অগত্যা মুরগী বলল, ‘আমিই করব।’
এবং করতে শুরু করল।
গরমের দীর্ঘ দিনগুলোতে তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হল। আগের মত খুঁটে খুঁটে বাচ্চাদের পোকাও খাওয়াত আবার গমের চারাগুলোও দেখাশুনা করত। এদিকে শূকর, বিড়াল, ইঁদুর তখন খাচ্ছিল, ঘুমাচ্ছিল আর মোটা হচ্ছিল। দিনে দিনে চারাগুলো বড় হতে লাগল।
দেখতে দেখতে গমের চারাগুলো পেকে উঠল এবং ফসল কেটে নেওয়ার সময় হয়ে গেল। মুরগী আবার গিয়ে গিয়ে সবাইকে ডাকল, ‘তোমাদের মধ্যে ফসল কে কাটবে?’
শূকর বলল, ‘আমি না’, বিড়াল বলল, ‘আমি না’, ইঁদুরও বলল, ‘আমি না’।
‘ঠিক আছে তাহলে’, মুরগী বলল, ‘আমিই করব।’
এবং করতে চলে গেল।
গোলাঘরের কৃষকের কাস্তে নিয়ে সে সোজা ক্ষেতে গেল। একা একাই পেকে যাওয়া গম কাটতে শুরু করল।
গম কাটা হয়ে যাওয়ার পর সেগুলোকে মাঠে সুন্দরভাবে বিছিয়ে রাখল। এবার তাদেরকে আঁটিতে বেঁধে মাড়াই করতে নিতে হবে। এদিকে তার ছোট্ট, হলুদ বলের মত তুলতুলে বাচ্চাগুলো মাকে না পেয়ে অধৈর্য হয়ে গেল। তারা যখন তখন মায়ের কাজে হানা দিতে লাগল। একটা সোরগোল তুলে তারা মায়ের মনোযোগ নিতে চেষ্টা করল।
বেচারি মুরগী! দোটানায় পড়ে সে বুঝতে পারল না কোন দিকে যাবে। বাচ্চাদেরও মনোযোগ দিতে হচ্ছে আবার এত কষ্ট করে ফলানো ফসলটাকেও ফেলে রাখতে পারছে না।
তাই এবার মনে একটু আশা নিয়ে সে সবাইকে ডাকতে গেল, ‘তোমাদের মধ্যে গমগুলো মাড়াই করতে কে যাবে?’
শূকর ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করে বলল, ‘আমি না’; বিড়াল মিউ মিউ করে বলল, ‘আমি না’; ইঁদুরও চিঁ চিঁ করে বলল, ‘আমি না’।
এবার মুরগী একটু হতাশ হল। কিন্তু তবুও দমে না গিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে তাহলে, আমিই করব।’
এবং করতে শুরু করল।
প্রথমে সে নিজের বাচ্চাদের খাওয়াল, তারপর তাদের সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে বিকেলে ক্ষেতে গিয়ে গম মাড়াই করল। মাড়াই শেষে চিৎকার করে ডাকল, ‘তোমাদের মধ্যে গম থেকে ময়দা বানানোর জন্য কলে নিয়ে যাবে কে?’
মুখ ফিরিয়ে মুচকি মুচকি হেসে শূকর বলল, ‘আমি না’, বিড়াল বলল, ‘আমি না’, ইঁদুরও বলল, ‘আমি না’।
মুরগীর আর কিছু করার ছিল না। তাই সে বলল, ‘ঠিক আছে তাহলে, আমিই করব।’
এবং করতে চলে গেল।
অনেক কষ্ট করে সে গমগুলো টেনে টেনে কলে নিয়ে গেল। গমের কলে সুন্দর ধবধবে সাদা ময়দা তৈরি হল। কলের মালিক তাকে ময়দা এনে দিল। ময়দার ভারি থলেটা ধীরে ধীরে টেনে এনে অনেক কষ্টে গোলাঘরে ফিরে আসল।
এত ভারি একটা বোঝা টানার পরও একটু পর পর সে খুঁটে খুঁটে পোকা ধরছিল। একটা নাদুস নাদুস পোকা মুখে করে ছানাদের জন্য নিয়েও এল। নরম তুলোর মত মুরগীর ছানারা মাকে পেয়ে কী যে খুশি হল! প্রথমবারের মত তারা মায়ের না থাকার কষ্ট বুঝতে পারল।
অন্যান্য দিন সূর্য ডোবার পর অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত মুরগী ঘুমাতে যেত না। কিন্তু আজ সারাদিনের খাটুনির পর সে একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ল।
সকালে একটু বেলা করে ঘুমানোর ইচ্ছে হচ্ছিল তার। কিন্তু ভোর হলেই সব মোরগ মুরগী একত্রিত হয়ে ডাকতে শুরু করে। ছানারা তাকে ঠেলে ঠেলে সেখানে নিয়ে গেল। বিছানায় শুয়ে থেকে আর আরাম করতে পারল না ছোট লাল মুরগী।
এমনকি যখন ঘুম থেকে উঠি উঠি করছে, তখন বিছানায় শুয়ে থেকেও তার মাথায় চিন্তা ছিল যে আজ ময়দা থেকে রুটি বানাতেই হবে।
যদিও আগে কখনো সে ময়দা থেকে রুটি বানায় নি, তবুও তার বিশ্বাস ছিল যে যত্ন নিয়ে নিয়ম অনুযায়ী কাজ করে গেলে সে রুটি বানাতে পারবে। এ পর্যন্ত যেটুকু করেছে তার পুরোটা এভাবেই হয়েছে।
বাচ্চাদের খাইয়ে পরিয়ে সে শূকর, বিড়াল আর ইঁদুরদের কাছে ছুটে গেল। এখনো তার বিশ্বাস, কখনো না কখনো তারা কাজে লাগবে। সে ডাকল, ‘তোমাদের মধ্যে রুটি বানাতে কে আসবে?’
কিন্তু হায়! আরও একবার তার আশা ভেঙ্গে চুর চুর হয়ে গেল। শূকর বলল, ‘আমি না’, বিড়াল বলল, ‘আমি না’, ইঁদুরও বলল, ‘আমি না’।
ছোট লাল মুরগী আবারও বলল, ‘ঠিক আছে তাহলে, আমিই করব।’
এবং করতে শুরু করে দিল।
সে একরকম শুরু থেকেই জানত যে, সবটা কাজ তার একাই করতে হবে। তাই একটা রান্নার অ্যাপ্রন আর টুপি পরে সে কাজে লেগে গেল। প্রথমে পরিমাণমত ময়দা মেখে খামি তৈরি করল। তারপর খামিকে পাউরুটির মত টুকরো টুকরো করে নিল। একটা রুটি সেঁকার টিনে খামির টুকরোগুলো বসিয়ে তন্দুর চুলায় ঢুকিয়ে দিল। পুরোটা সময় বিড়ালটা পাশে বসে থেকে মুখ চেপে চেপে হাসল।
অকর্মা ইঁদুরটাও কাছেই ছিল। আয়নার সামনে বসে প্রসাধন করছিল আর নিজেই নিজেকে দেখে প্রশংসা করছিল।
একটু দূরে শূকরটা ঘুমিয়ে ছিল। তার নাক ডাকার শব্দও পাওয়া যাচ্ছিল।
তারপর এল সেই বিশেষ মুহূর্ত। শরতের বাতাসে সুস্বাদু রুটির সুবাস ছড়িয়ে পড়ল। গোলাঘরের সবাই রুটির সুগন্ধ পেয়ে জড়ো হয়ে গেল।
ছোট লাল মুরগী প্রথমে ভাবতে পারে নি যে সে একা একাই সব করে ফেলতে পারবে। খুশিতে তার নাচতে আর গাইতে ইচ্ছে করছিল। যদিও তেমন কিছু না করে সে স্বাভাবিকই ছিল।
আস্তে আস্তে হেলে দুলে সে অন্যদের দিকে এগিয়ে গেল। গোলাঘরের সবাই তখন তার দিকে তাকিয়ে আছে।
এখনো সে জানে না রুটিটা কেমন হয়েছে বা আদৌ খাওয়া যাবে কি না, কিন্তু কাজটা শেষ করতে পেরে কী যে আনন্দ হচ্ছে! সুন্দর বাদামি রঙের রুটিগুলো চুলার ভেতর থেকে বের করে দেখল, এত চমৎকার রুটি আর হয় না। রুটির গন্ধেই সবার খিদে লেগে গেল। তারা নিজেদের জিভে চাটতে লাগল।
মুরগী হয়তো স্বভাবের বশেই বলে বসল, ‘ তোমাদের মধ্যে কে কে রুটি খাবে?’
শূকর বলল, ‘আমি খাব’, বিড়াল বলল, ‘আমি খাব’, ইঁদুরও বলল, ‘আমি খাব’।
কিন্তু তখন ছোট লাল মুরগীটি বলল, ‘না, তোমরা কেউ খাবে না, আমি খাব’।
এবং সে-ই খেল।
[ এটি মূলত একটি রাশান লোকগল্প। ইংরেজিতে অনূদিত নাম দ্য লিটল রেড হ্যান। বর্তমান অনুবাদটি মার্গট যেমাখ’এর ইংরেজী গল্প থেকে অনূদিত। সেটির লিঙ্ক এখানে। ]
২১/০৫/২০১৬ শ্যামলী, ঢাকা।
Comments