top of page

প্রিন্সেস মনোনকি

প্রকৃতির কোলে জন্ম মানুষের। অন্য সব প্রাণী, পাখি, উদ্ভিদ, জলজ, কীট পতঙ্গ আর সরীসৃপের মত মানুষও ছিল প্রকৃতির অভিন্ন সন্তান। পৃথিবীর মাটি, আলো, বাতাস, জলই ছিল তার জীবনের অনুষঙ্গ। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম ভেঙ্গে মানুষই প্রথম বেরিয়ে আসার দুঃসাহস করেছিল। আজকের এই সভ্যতা, স্বাচ্ছন্দ্য ও উৎকর্ষের মূলে আছে এই দুঃসাহস। মানুষই প্রথম প্রকৃতির ইচ্ছায় নিজের জীবন যাপনের বদলে প্রকৃতিকে নিজের ইচ্ছায় নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। কিন্তু এমনই সর্বনাশা মানুষের স্বভাব যে, প্রকৃতিকে বশ করে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর, তার সাথে সদ্ভাব বজায় না রেখে একে কুক্ষিগত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত লোভের বশে গড়ে তোলে অপরিকল্পিত নগর। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে দূর্যোগের রূপে মাঝে মাঝেই প্রকাশ পেয়েছে প্রকৃতির সন্তাপ। মানুষের নির্বোধ লোভের বলি হয়েছে গাছপালা, বন্য প্রাণী, বাস্তুসংস্থান এবং ফলত মানুষ নিজে।

প্রকৃতির সাথে সম্পর্কহীন, একরোখা নগরায়নের অশুভ পরিণামকে চিত্রায়িত করে ১৯৯৭ সালে জাপানের স্টুডিও ঝিবলিতে নির্মিত হয় ‘মনোনকি হিমে’ বা ‘প্রিন্সেস মনোনকি’ অ্যানিমেশন ফিল্ম। পরিবেশ রক্ষার বহু উচ্চারিত কথাগুলো আউড়ানো হয় নি এতে। মধ্যযুগের জাপানের সংস্কৃতি, এর পৌরাণিক নির্যাস, মানুষে মানুষে সম্পর্ক, বন্য প্রাণী ও বনভূমির আত্মিক সম্পর্ক, বিভিন্ন জাতির মধ্যে যুদ্ধ ও রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ, নারীর ক্ষমতায়ন, শারীরিক অক্ষমদের পুনর্বাসন সবই উঠে এসেছে কাহিনীর পরতে পরতে। একটি সার্থক মহাকাব্যে যেভাবে চরিত্রের বিকাশ, ঘটনার প্রবাহমানতা আর সুবৃহৎ দৃশ্যপট থাকে, ১৩৩ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটিতে তাই সফলভাবে করে দেখানো হয়েছে।

প্রিন্সেস মনোনকির পোস্টার


ফিল্মটির পরিচালক হায়াও মিয়াযাকি অ্যানিমেশন জগতের জীবন্ত কিংবদন্তী। অর্ধশতাধিক বছর ধরে তিনি অ্যানিমেশনের সাথে জড়িত। তাঁর অ্যানিমেশন বাণিজ্যিক সাফল্য এবং সমালোচকের প্রশংসা দুই-ই অর্জন করেছে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক রজার ইবার্ট তাঁকে জাপানের জাতীয় সম্পদ (National treasure of Japan) বলে অভিহিত করেছেন। তাঁকে তুলনা করা হয় ওয়াল্ট ডিজনি এবং ব্রিটিশ অ্যানিমেটর নিক পার্কের সাথে। হাতে আঁকা অ্যানিমেশন দিয়ে তিনি বাঘা বাঘা অ্যানিমেটরকে টেক্কা দিয়েছেন, যাঁরা প্রচুর সফটওয়্যার ব্যবহার করেই সাফল্য পেয়েছিলেন।


প্রিন্সেস মনোনকির গল্পটি জাপানের ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনীর সংমিশ্রণে গাঁথা হয়েছে। মুরোমাশি যুগে (১৩৩৭ – ১৫৭৩ খ্রিঃ) জাপানের পূর্বাঞ্চলে এমিশি জাতির বাস ছিল। এর রাজপুত্র আশিটাকার অভিযানই গল্পের মূল প্রসঙ্গ। শুরুতেই আমরা দেখি জঙ্গলের ভেতর থেকে এক অতিকায় শূকর বেরিয়ে আসে। এর সারা শরীর সাপের মত কিলিবিলে পদার্থে ভর্তি। দানবটি এমিশি গ্রামকে আক্রমণ করতে গেলে রাজপুত্র আশিটাকা তাকে ফিরে যেতে অনুরোধ করে। কিন্তু অপারগ হয়ে, তীর মেরে হত্যা করতে বাধ্য হয়। কিন্তু লড়াইয়ের সময় দানবটির সর্পিলাকার শুঙ্গ তার ডান হাতে স্থায়ী দাগ রেখে যায়।

শূকর দেবতা বা তাতারি গামি


গ্রামের প্রবীন, জ্ঞানী বৃদ্ধা হিসামা পাথর ও কাঠের টুকরা দিয়ে ভবিষ্যৎ গণনা করে বলেন শূকরটি ছিল পশ্চিমের দেশের বনরক্ষী দেবতা। তার ভেতরে বিষাক্ত লোহার গুলি ঢুকে তাকে পাগল করে তোলে। তীব্র কষ্টে ও ঘৃণায় তার হৃদয় পূর্ণ হয়ে তাকে দানবে পরিণত করে। আশিটাকার হাতের দাগটি বড় হতে হতে তার পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়বে এবং তাকে অবর্ণনীয় কষ্ট সয়ে মরতে হবে। ক্ষতের কষ্ট সত্ত্বেও ঘৃণার বশবর্তী না হয়ে পশ্চিমের দেশে এর আরোগ্য খুঁজতে হবে। তার গোষ্ঠীর নিয়ম অনুযায়ী তাকে চুলের গোছা কেটে, গ্রামের মানুষের কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়ে সে রাতেই বেরিয়ে যেতে হয়।


জঙ্গল, পর্বত, বন্ধুর রাস্তা, সমতল ভূমি, নদী পেরিয়ে তার যাত্রা চলতে থাকে। একটি গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় দেখে সেখানে খুনে সামুরাইরা লুঠ আর হত্যাকান্ড চালাচ্ছে। তাদের তীর ছুঁড়তে গিয়ে লক্ষ্য করে, তার হাতে অদ্ভুত নাড়াচাড়া। তীর মেরে সে দুই সামুরাইয়ের শরীর থেকে হাত আর ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দ্রুত সরে যায়। সে নিজেই অবাক হয়ে যায় তার অভূতপূর্ব শক্তিতে। পথে এক সন্ন্যাসীর সাথে দেখা হয়। সন্ন্যাসী তাকে জানায়, পশ্চিমের দেশে পর্বতের উপর বনের দেবতা প্রধানের বাস। কিন্তু সেখানে সব প্রাণীই বিপুলাকার, তাই মানুষের জন্য বিপদজনক।


বনের কাছে ছিল নতুন শহর তাতারা বা, যার অর্থ লৌহনগরী। নেকড়ে দলের সাথে মানুষের লড়াইয়ে নেকড়ে প্রধান মোরো গুলিবিদ্ধ হয় এবং কয়েকজন মানুষ নিখোঁজ হয়। আশিটাকা তাদের দুজনকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। আহতদের স্বজনরা উল্লসিত হয় এবং আশিটাকা বীরের অভ্যর্থনা পায়। সে দেখে তাতারা বা এক বিরাট কর্মযজ্ঞের শহর। সেখানে সে জানতে পারে এর প্রধান লেডী এবোশী গণিকালয় থেকে নারীদের কিনে এনে লৌহনগরীর হাপর চালানোর কাজ দেন। এবোশীই নাগো নামের শূকর দেবতাকে গুলি করেছিলেন। তিনি কুষ্ঠ রোগীদের পুনর্বাসন করে মারণাস্ত্র তৈরীর কাজ দিয়ে রেখেছেন। তাকে লোহা প্রক্রিয়াজাতকরণ ও অস্ত্র তৈরির এলাকাটি ঘুরে দেখান হয়। আশিটাকা জানতে পারে বনের অধীশ্বর শিশি গামিকে হত্যা করলে বনের রাজকন্যা প্রিন্সেস মনোনকি আবার মানুষে পরিণত হবে। এবোশী একাজে তার সাহায্য চায় এবং তার ক্ষত সারিয়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়। আশিটাকা নারী শ্রমিকদের কাজের এলাকাটিও দেখে এবং তাদের সাথে কিছুক্ষণ হাপর চালায়।

লেডী এবোশী


সে রাতে এবোশীকে হত্যা করার জন্য প্রিন্সেস মনোনকি শহরে আচমকা আক্রমণ করে বসে। সে ছিল নেকড়ে মোরোর পালক মেয়ে সান। সান ও এবোশী দ্বন্দ্বযুদ্ধে মুখোমুখি হলে আশিটাকা তাদের দুজনকে অজ্ঞান করে লড়াই থামায়। সানকে নিয়ে শহর ত্যাগ করার সময় সে গুলিবিদ্ধ হয়। সান তাকে শিশি গামির কাছে নিয়ে গেলে তিনি গুলির ক্ষত সারিয়ে দেন কিন্তু তার হাতের দাগ আগের মতই থেকে যায়। সান মুমূর্ষু আশিটাকাকে শুশ্রূষা করে বাঁচিয়ে তোলে।

এদিকে সন্ন্যাসী জিগো বাউ বনদেবতাকে হত্যা করার জন্য তাঁকে অনুসরণ করতে থাকে। কারণ, রাজ্যের সম্রাট অমরত্ব পাওয়ার জন্য শিশি গামির মাথার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। সে জানতে পারে, বনের শূকর জাতি তাদের প্রধান ওক্কোটোর নেতৃত্বে মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ যুদ্ধে এবোশীর মারণাস্ত্রের সামনে শূকর জাতি টিকতে পারে না। সে সাথে নিহত হয় তাতারা বার প্রচুর মানুষ। শূকরদের হারিয়ে এবোশী জিগো বাউয়ের যোদ্ধাদের নিয়ে বনদেবতা শিশি গামিকে হত্যা করতে যায়।


এবোশীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সম্রাট আসানোর যোদ্ধারা লৌহনগরী আক্রমণ করে দখল করে নেওয়া চেষ্টা করে। আশিটাকা এই খবর নিয়ে বনদেবতার সরোবরে এবোশীর কাছে যায় এবং তাকে নিজের শহরের রক্ষার্থে ফিরে যেতে বলে কিন্তু এবোশী তার কথা শোনে না। যুদ্ধে গুরুতর আহত ওক্কোটো, সান, মোরো সবাই সরোবরে ছিল। গুলিবিদ্ধ ওক্কোটো ক্রমে তাতারি গামির মত দানবে পরিণত হতে থাকে। শিশি গামি এসে ওক্কোটো এবং মোরো উভয়ের প্রাণ নিয়ে নেয়। এবোশী গুলি করে শিশি গামির মাথা আলাদা করে ফেলেন আর জিগো বাউয়ের লোকজন সেটা বাক্সবন্দী করে নিয়ে যায়। মোরো মৃত্যুর আগ মুহূর্তে এবোশীর একটি হাত কামড়ে ছিন্ন করে ফেলে।


মাথা হারানোর পর শিশি গামি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ে যায়। তাঁর বিক্ষিপ্ত শরীর হন্যে হয়ে মাথাটি খুঁজতে থাকে। প্রলয় নেমে আসে চারদিকে। সেই বিক্ষিপ্ত শরীরের অংশ যাকে স্পর্শ করে সেই মারা যায়। জিগো বাউ মাথাটি নিয়ে পালাতে চেষ্টা করে। সূর্য ওঠার মধ্যে যদি শিশি গামি মাথাটি ফের না পান তাহলে তিনি আর জীবিত থাকবেন না। আশিটাকা ও সান তাঁর মাথাটি উদ্ধার করে শিশি গামিকে ফেরৎ দেয়। আবার সজীব হয়ে উঠেন শিশি গামি। লৌহনগরীসহ সকল প্রকৃতিবিরোধী অশুভ প্রচেষ্টাকে ধ্বংস করে, বনের শ্যামলিমা ফিরিয়ে দিয়ে মিলিয়ে যান তিনি। আশিটাকা ও সানের শরীর থেকে সকল অভিশাপের দাগ সরে যায়। এবোশী নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং আশিটাকাকে নিয়ে নতুন করে আরেকটি শহর গড়ার কথা ভাবেন, এ শহরটি হবে লৌহনগরীর চেয়েও ভাল আর প্রকৃতিবান্ধব।

প্রিন্সেস মনোনকিতে অদ্ভুত সুন্দর কাহিনীর মধ্যে সন্নিবিষ্ট হয়েছে কিছু কাল্পনিক প্রাণী। শূকর দেবতা বা তাতারি গামি, যার শরীরের বাইরের দিকটা ছিল কিলবিলে সর্পিলাকার। আকাশিশি বা লাল হরিণ ইয়াক্কুল, যার শিং বাঁকানো, গলায় কেশর ও ঘোড়ার মত দৌড়ানোর ক্ষমতা। জঙ্গলের অধীশ্বর শিশি গামির দিন ও রাতের জন্য বরাদ্দ দুই রূপ। দিনে আঁকাবাঁকা একগুচ্ছ শিংযুক্ত হরিণ যার মুখটি মানুষের মত আর রাতের বেলা সুদীর্ঘ, স্বচ্ছ, নীলচে শরীর। এগুলো সবই মিয়াযাকির সৃষ্টিশীল কল্পনার ফসল।

প্রিন্সেস মনোনকির কাল্পনিক প্রাণী – ইয়াক্কুল, শিশি গামির দিন ও রাতের রূপ


মূলত হাতে আঁকা প্রিন্সেস মনোনকির ফ্রেমগুলো ডিজনির আধুনিকতম অ্যানিমেশনের সাথে তুলনীয়। এর সাথে কম্পিউটার গ্রাফিক্সের টেক্সচার ম্যাপিং, থ্রিডি রেন্ডারিং, মরফিং, পার্টিক্যাল ও ডিজিটাল কম্পোজিশান ব্যবহার করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলোও আঁকার মধ্যে গভীর মনযোগ পেয়েছে। পানিতে কিছু ডুবালে সৃষ্ট তরঙ্গ, জলের নিচে পায়ের ছাপ, পাতার ফাঁকে সূর্যের আলো, জঙ্গলের ভেতর আলো ছায়ার খেলা, জলের উপর দিয়ে শিশি গামি আলতোভাবে হেঁটে গেলে সুন্দর তরঙ্গ সৃষ্টি, বাতাসে ঘাসের নড়াচড়া, পাথরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করলে তার রঙ বদলে যাওয়া, বৃষ্টি এলে রোদ সরে গিয়ে আঁধার ঘনিয়ে আসা, আশিটাকা চোখের নিচে কাটা নিয়ে ভারী গেইট ঠেলে খুলতে গেলে ক্ষত থেকে রক্ত ছলকে ওঠাসহ কোন কিছুই আর্ট ডিজাইন থেকে বাদ পড়েনি। ফিল্মটির ১,৪৪,০০০ অ্যানিমেশন সেলের সবই মিয়াযাকি তত্ত্বাবধান করেছেন এবং ৮০,০০০ টি নিজে সংশোধন করেছেন।


ফিল্মটিতে কন্ঠশিল্পীরা সম্পূর্ণ দরদ দিয়ে কাজ করেছেন। এমনকি ভাষান্তরিত ইংরেজীতেও দক্ষ কন্ঠকুশলীদের নিয়ে কাজ করা হয়েছে, যাঁরা এর ভাবগাম্ভীর্য খর্ব হতে দেয় নি এতটুকু। সিনেমাটির আবহ সঙ্গীত মন হরণ করার মত। বিখ্যাত সঙ্গীতকার জো হিসাইশি কাহিনীর গতিপ্রকৃতি হিসেবে যখন যে ধরণের সুর দরকার যেন তাই এনে হাজির করেছেন এবং প্রয়োজনবোধে করেছেন নিঃশব্দের ব্যবহার। ছবিটিতে দুটি গান ছিল। তাতারা মহিলাদের কাজের সময় সকলের সুর করে গাওয়া গান এবং কাহিনীর মূল গান বা থিম সং। দুটি গানের কথাই লিখেছেন গীতিকার মিয়াযাকি। প্রিন্সেস মনোনকি দেখতে গিয়ে তাঁর এই প্রতিভাটির কথাও জানা গেল। বনের প্রধান দেবতা শিশি গামির উপস্থিতির সময় কোন শব্দ ব্যবহার হয় নি, যেন চারদিকে সবাই সুনসান নীরবতায় তাঁকে প্রত্যক্ষ করছে, সেই সাথে আমরাও।


মিয়াযাকির ছবির বিশেষত্ব হল তিনি সাধারণত খলচরিত্র বা ভিলেন ছাড়া কাহিনী তৈরি করেন। এখানেও আপাতভাবে লেডী এবোশীকে খল মনে হলেও এ চরিত্রেরও আছে শুভ দিক। তিনি সমাজের অস্পৃশ্য কুষ্ঠরোগীদের মানুষ হিসেবে দেখেছিলেন। তিনিই প্রথম তাঁদেরকে নিজের শহরে এনে ক্ষত ধুয়ে ব্যান্ডেজ করে দেন এবং রাইফেল তৈরির কাজ দেন। তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে নারী যৌনকর্মীদের সংগ্রহ করে তাতারা বা শহরে এনে লৌহশিল্পের কারখানায় হাপর চালানোর কাজ দেন। সেই কাজ অত্যন্ত শ্রমসাধ্য হলেও নারীকর্মীরা বলেন, তাঁদের আগের কাজের তুলনায় একাজ অনেক বেশি মানবিক। এবোশীর মধ্যে ছিল নেতৃত্ব দানের অসামান্য যোগ্যতা। তাই তাঁর শহরের নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার কাছে তিনি উচ্চ শ্রদ্ধার আসনে স্থিত। জঙ্গলের দেবতাদেরও তিনি অকুতোভয়ে লড়াই করতেন। এক্ষেত্রে তিনি শুভ পক্ষ অবলম্বন না করলেও তাঁর সাহস প্রশংসনীয়।


আশিটাকা ও সানের প্রেমের চিত্রায়ণ ছবিটির একটি বিশেষ দিক। তারা পরস্পর ভিন্ন মতের অনুসারী। সান চরম মানুষ বিদ্বেষী আর আশিটাকা যেকোন ধরণের সহিংসতা বিরোধী। তারা প্রত্যেকেই একে অপরের প্রাণ বাঁচিয়েছিল। সানের প্রাণ বাঁচাতে আশিটাকা গুলিবিদ্ধ হয়। মুমূর্ষু আশিটাকাকে দীর্ঘদিন শুশ্রূষা করে বাঁচায় সান। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও অপদেবতায় পরিণত হওয়া ওক্কোটোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সানকে বাঁচাতে চায় আশিটাকা। কিন্তু গল্পের কোথাও কাউকে প্রেম নিবেদন করতে দেখা যায় নি। যেন একে অপরের মনের কথা এতটাই নিশ্চিতভাবে জেনে গিয়েছিল যে, মুখ ফুটে বলার প্রয়োজন হয় নি। গল্পের শেষেও তারা একত্রে থাকার কথা বলে নি। সান তার আরণ্যক জীবন বেছে নেয় আর আশিটাকা তাতারা বা শহরকে নতুনভাবে গড়তে যায়। তারা মাঝে মাঝে দেখা করার প্রতিশ্রুতি করে। প্রত্যেকে নিজের নিজের জীবনযাত্রায় থেকে প্রেমের সম্পর্ক বজায় রাখা পৃথিবীর যে কোন দেশের কাহিনীতেই বিরল।


পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি এখানে বার বার উচ্চারিত হয়েছে ঘৃণা পুষে না রাখার কথা। ঘৃণা হচ্ছে জ্বলন্ত কয়লার মত। যার হাতে থাকে তাকেও জ্বালায়, যাকে ছুঁড়ে মারা হয় তাকেও পোড়ায়। ভবিষ্যৎ বক্তা হিসামা আশিটাকাকে বলেছিলেন, ঘৃণার বশবর্তী না হয়ে আরোগ্য খুঁজতে। আশিটাকাও এবোশী আর বনের প্রাণীদের যুদ্ধে কোন পক্ষ না নিয়ে বার বার ঘৃণাহীন সহাবস্থানের কথা বলেছিল। সান আর এবোশীর দ্বন্দ্বযুদ্ধে সে দুজনকে থামিয়ে দিয়ে শহরবাসীর উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করে সেই অমোঘ উক্তি, যা পুরো ছবিটির সার বক্তব্য। সে বলে, ‘Look, everyone! This is what hatred looks like. This is what it does when it catches hold of you. It's eating me alive and very soon now it will kill me! Fear and anger only make it grow faster.’


সবার অধিকার রক্ষা করে মানবিক নগর গড়ার বার্তাই এখানে দেওয়া হয়েছে। মানুষ প্রকৃতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজের কষ্টই শুধু বাড়িয়েছে। ছবিটিতে বনের প্রাণীরা পরস্পরের ব্যাপারে যতটা শ্রদ্ধাশীল, মানুষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী একে অন্যের ব্যাপারে ততটা নয়। নেকড়ে ও শূকর জাতি একে অন্যকে অপছন্দ করত, তাই এড়িয়ে চলত। কিন্তু মানুষেরা রাজ্য দখল করে ধ্বংস করে দিত প্রতিদ্বন্দ্বী জাতিকে। কিছু কিছু মূল্যবোধকে মানুষ পুরনো বা সেকেলে আখ্যা দিয়ে ফেলে দেওয়ার আক্ষেপ থেকে থেকে প্রকাশ পেয়েছে।


অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রিন্সেস মনোনকি জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের মত। রটেন টোমাটোসের ৮৪ জনের পর্যালোচনার ভিত্তিতে এটি এখনো ৯৪% তরতাজা। আই. এম. ডি. বি শীর্ষ ২৫০ সিনেমার তালিকায় ১০ এর পূর্ণমানে ৮.৪ পেয়ে এটি ৯৩ তম অবস্থানে আছে। মেটাক্রিটিক আবার ২৯ জনের পর্যালোচনায় একে ১০০ তে ৭৬ নম্বর দিয়েছে। রজার ইবার্ট ১৯৯৯ সালের সকল চলচ্চিত্রের উৎকর্ষের ক্রমে একে ৬ষ্ঠ অবস্থানে রেখেছেন।

ফিল্মটি ১৯৯৮ সালে জাপানীজ একাডেমীর সেরা চলচ্চিত্র, ২০০১ সালের স্যাটার্ন পুরস্কার, ব্লু রিবন ও হোচি ফিল্ম পুরস্কারসহ বিভিন্ন বিভাগে অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নেয়। এছাড়াও অনেক আসরে বিভিন্ন বিভাগে মনোনয়ন পায়।


২৪০ বিলিয়ন জাপানীজ ইয়েনে প্রস্তুত ছবিটি বক্স অফিসেও সফল হয়। ১৯৯৭ সালে জাপানের মধ্যে এটিই ছিল সর্বাপেক্ষা ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র, পরে টাইটানিক একে ছাড়িয়ে যায়। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অ্যানিমেশন ছবির মধ্যে এটি ছিল সর্বাধিক বিক্রিত। এর কাহিনী অবলম্বনে পরে মঞ্চনাটক, কমিক্স বই ও টিভির জন্য কার্টুন সিরিয়াল তৈরি হয়।


অবশ্য দ্রষ্টব্য চলচ্চিত্রের মধ্যে প্রিন্সেস মনোনকি সামনের দিকে থাকার মত। কারণ, এখানে আছে প্রকৃতির কথা, শাশ্বত প্রেমের কথা, মানুষের কথা, মানবতার কথা আর অভিশপ্ত জীবনের যাতনার কথা। কোন চোখ ঝলমলে নগর যেন মানুষের স্বাভাবিক দেখার চোখকে অন্ধ করে না দেয়, তাই বার বার অনুরোধে আকুতিতে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। ছবিটি দেখতে দেখতে কবিগুরুর কবিতার চরণগুলো বার বার মনে পড়ে,

দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী, দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি, ... ... ... চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার, বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার, পরানে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধন অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।

Featured Writing
Tag Cloud
No tags yet.
bottom of page