top of page

নিউজিল্যাণ্ডের লোকগল্প: অদম্য সাঁতারু

নিউজিল্যাণ্ডের উত্তর ভূ-খণ্ডে এক সুবিশাল হ্রদ আছে, তার নাম রোতোরুয়া। তার পাড়ে থাকতো এক কিশোরী মেয়ে। তাকে সবাই হিনে-মোয়া নামে ডাকতো। সে ছিল তার বাবা মায়ের সকল আনন্দের উৎস, তাদের গৌরব। তারা তাদের গোত্র স্থপতির সরাসরি বংশধর। সবাই জানতো যে, পরিবারের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য মেনে হিনে-মোয়া একদিন অভিজাত পরিবারের কোন ছেলেকে বিয়ে করবে।


রোতোরুয়া হ্রদের মাঝখানে আছে মোকোইয়া নামের এক দ্বীপ। সেই দ্বীপে আরেক গোত্রের লোকজন বাস করতো। সেখানে একটা লাজুক ছেলে ছিল, তার নাম তুতানেকাই। তার এত লজ্জা ছিল যে, মাঝে মাঝেই সে কী বলবে ভেবে পেত না। অন্য ছেলেমেয়েরা তাকে এজন্য প্রায়ই খেপাত।


হিনে-মোয়ার গোত্র আর তুতানেকাইয়ের গোত্রের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। একসাথে তারা সাঁতারের প্রতিযোগিতা আর নৌকা বাইচের অনুষ্ঠান আয়োজন করতো। সেসব অনুষ্ঠানে নানা ধরনের খেলাধুলার ব্যবস্থাও থাকতো। একদিন মোকোইয়ার ছেলেটি রোতোরুয়া হ্রদে নৌকা বেয়ে ঐতিহ্যবাহী নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আসলো। তার ভাই আর বন্ধুরা সাথে ছিল। অনুষ্ঠানের আয়োজকদের উপহার দেওয়ার জন্য সবাই সাথে করে নানারকম ফলমূল নিয়ে এসেছিল।


নাচ শুরু হতেই দর্শকরা ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। যেই না তুতানেকাই হিনে-মোয়াকে দেখল, সাথে সাথে তার প্রেমে পড়ে গেল। মেয়েটিও যখন হ্রদের পাড়ের দিকে তাকালো, তার চোখ গেল তুতানেকাইয়ের দিকে। আর সেও প্রেমে পড়ে গেল। কিন্তু দুই কিশোর কিশোরী লজ্জায় একে অপরের সাথে কথা বলে উঠতে পারল না।


তুতানেকাই তার দ্বীপে ফিরে গেল। পাহাড়ের উপরে উঁচু জায়গা দেখে সে নিজের জন্য একটা কুটির বানালো। দিনের পর দিন সে কুটিরে বসে হ্রদের দিকে চেয়ে থাকত। তার চোখ দুটো হিনে-মোয়াকে খুঁজত। সন্ধ্যায় সে তার বাঁশিটা বাজাত। বাতাস অনুকূল থাকলে তুতানেকাইয়ের করুণ বেদনা ভরা বাঁশির সুর হিনে-মোয়ার কানে পৌঁছাত। আকাশের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি উজ্জ্বল চাঁদটাকে দেখতে পেত। আনন্দে তার চোখ জলে ভরে যেত। সে জানতো, বাঁশির সুরটা তার জন্যই বাজানো হচ্ছে।


এভাবে সময় গড়িয়ে গেল। এরমধ্যে যখনই তাদের গোত্রের মধ্যে খেলাধুলা বা নাচের অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে, তখন তাদেরও দেখা হয়েছে। একবার সবার অগোচরে ছেলেটি মেয়েটির হাত ধরল, মেয়েটিও ছেলেটির হাত ধরল। তুতানেকাই তাতে একটু সাহস পেল। তারপর নিজের বাড়িতে ফিরে এসে সে হিনে-মোয়ার কাছে নিজের লোক পাঠাল। লোকটি গিয়ে হিনে-মোয়াকে বলে আসলো, তুতানেকাই তাকে ভালোবাসে। হিনে-মোয়া কথাটি শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, ‘আমাদের ভালোবাসা অভিন্ন’। বার্তাবাহক নৌকা বেয়ে ফিরে আসলো এবং হিনে-মোয়ার কথাটি ছেলেটিকে বলল।


তুতানেকাই মেয়েটির কাছে আবার খবর পাঠাল। সময় হলে সে তার বাঁশিতে সুর তুলবে, তখন যেন হিনে-মোয়া মোকোইয়া দ্বীপে চলে আসে। মেয়েটিও বার্তাবাহকের মাধ্যমে কথা দিল, যখনই তাকে ডাকবে সে একটা ডিঙি নৌকা বেয়ে ছেলেটির দ্বীপে চলে আসবে।


কিন্তু হিনে-মোয়ার বাবা মা তার পরিকল্পনার কথা জেনে গেল। মেয়ের ভালোবাসায় তাদের সম্মতি ছিল না। হিনে-মোয়া যেন কোন ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে চলে যেতে না পারে, সেজন্য তারা কূল থেকে সব নৌকা সরিয়ে নিল।


তারপর এলো গ্রীষ্মের সেই রাত। তুতানেকাই পাহাড়ের উপর উঠে নিজের কুটিরে বসল। তার সেই বিশেষ সুরটি সে বাজাতে শুরু করল, হিনে-মোয়াকে যা দিয়ে তার ডাকার কথা ছিল। সে বাজিয়ে চলল, বাজিয়েই চলল। চাঁদের ছায়া শান্ত হ্রদের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে চলে গেল। রাত পেরিয়ে ভোর হলো। কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষের কোন চিহ্ন দেখা গেল না।


পরের রাতে সে আবারও পাহাড়ের উপর উঠল। আবারও বাঁশিতে সুর তুলল। তার সুরে প্রেয়সীকে পাওয়ার আকাঙ্খা ছিল। পাহাড়ের নিচে তার বন্ধুরা জড়ো হয়েছিল। ‘শোনো তুতানেকাই কী বাজাচ্ছে,’ ঠাট্টা করে তারা বলল, ‘ও ভাবছে হিনে-মোয়া ওকে ভালোবাসে।’ এ নিয়ে তাদের মধ্যে অনেক হাসাহাসি হলো। ‘তুতানেকাই যে কী কী অদ্ভুত জিনিস ভেবে নেয়,’ তারা বলল।


নিজের কুটিরে বসে রাতের পর রাত সে বাঁশি বাজিয়ে গেল। কিন্তু হিনে-মোয়া এলো না।


রোতোরুয়া থেকে ভেসে আসা তুতানেকাইয়ের বাঁশির সুর হিনে-মোয়া কিন্তু ঠিকই শুনতে পেত। থেকে থেকে সে অস্থির হয়ে যেত, কিন্তু কী করবে ভেবে পেত না। শেষে একদিন হ্রদের পানিতে চোখ রাখল, গভীর থেকে গভীরে দৃষ্টি বাড়িয়ে দিলো। মনে আশা ছিল, জলের দেবী তাকে কোন একটা উপায় বলে দেবে। হিনে-মোয়া যেন তখনই জলদেবীর কথা শুনতে পেল, আর সাথে সাথেই সে বুঝে গেল তাকে কী করতে হবে।


তুতানেইকাই যেখানে থাকত, সেই মোকোইয়া দ্বীপ অনেক দূরের পথ। জলে ভেসে থাকার সুবিধার জন্য হিনে-মোয়া তার দুপাশে ছয়টি লাউয়ের খোল বেঁধে নিল। তারপর একটা উঁচু পাথরের উপরে উঠে হ্রদের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেরাতে আকাশে কোন চাঁদ ছিল না। হিনে-মোয়া ভাবল, তাতে ভালোই হলো, এই অন্ধকারে তাকে কেউ দেখতে পাবে না। সে সাঁতরে চলল, সাঁতরেই চলল। একসময় তার হাত পা ব্যথায় অবশ হয়ে গেল। হ্রদের একটা পাড়ে একটা আধডুবো গাছের কাণ্ড ছিল। হিনে-মোয়া সেটার কাছে পৌঁছল। কাণ্ডটা ধরে থেকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সে শক্তি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করল। কেবল সাঁতারের ক্লান্তি নয়, ঠাণ্ডাও তাকে কাবু করে ফেলেছিল। একসময় তার ভয় হলো, সে বোধহয় গাছের কাণ্ডটা ধরে রাখতে না পেরে ডুবে যাবে।


তারপর আচমকা জলের উপরে মাথা জাগিয়ে সে আবারও বাঁশির সুর শুনতে পেল। তার প্রাণ আবারও নতুন শক্তিতে জেগে উঠল। জলে আধডুবো গাছের কাণ্ডটা ছেড়ে দিয়ে আবার সে সাঁতরাতে শুরু করল। প্রতিবার জল থেকে মাথা তুলে সে তুতেনেকাইয়ের বাঁশির সুর শুনতে পেল।

যেন বহুযুগ সাঁতরে পার হওয়ার পর হিনে-মোয়া গন্তব্যের কাছাকাছি এলো। অগভীর পানিতে পায়ের নিচে শক্ত পাথরের স্পর্শ পেল। এদিকে তুতানেকাই প্রেয়সীর দেখা না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে তার ঝুলবিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।


হিনে-মোয়া সাঁতরে রোতোরুয়া পেরিয়ে এসে মোকোইয়ার পাড়ে লুটিয়ে পড়ল। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে সে শক্তি ফিরে পেতে চেষ্টা করল। তখনই পাড়ের বালিতে যেন কারও পায়ের শব্দ পেল। সেদিকে ফিরে দেখল, তুতানেকাইয়ের পরিচারক লাউয়ের খোলে করে হ্রদ থেকে তার জন্য পানি নিতে এসেছে।


হিনে-মোয়া জিজ্ঞেস করল, ‘পানিটা কার জন্য নিচ্ছো?’


পরিচারক জলে অপরিচিত অবয়ব দেখে চমকে গেল। সবাইকে সতর্ক করে দিতে তখনই লাফ দিয়ে ছুটে পালাল।


ভয়ে পরিচারকের নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। দৌড়ে পাহাড়ে মনিবের কুটিরে ছুটে গেল সে। জানালো, জলের কাছে একটা দুষ্ট প্রেত লুকিয়ে আছে। তুতানেকাই সাথে সাথে গায়ে একটা আলখাল্লা জড়িয়ে নিল। হাতে একটা লাঠি নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে জলের দিকে এগিয়ে গেল। চিৎকার করে বলে উঠল, ‘বেরিয়ে এসো, চোর কোথাকার! তোমার খেলা এখনই খতম করছি!’


প্রেমিকের কণ্ঠ শুনে হিনে-মোয়া জলের কাছে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। পানির ধারে বিচরণ করার সময় তুতানেকাইয়ের দিকে সে সতর্কভাবে চোখ রাখল।


হঠাৎ মেয়েটি তার হাতে ছেলেটির হাতের স্পর্শ পেল। দুষ্ট প্রেত ভেবে সে যখন আঘাত করতে যাবে, তখনই হিনে-মোয়া আড়াল থেকে বেরিয়ে ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়াল।


‘হিনে-মোয়া,’ ছেলেটি আনন্দে বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল। প্রথমে তাকে জড়িয়ে ধরল, তারপর নিজের আলখাল্লাটা হিনে-মোয়ার গায়ে জড়িয়ে দিলো।


পরদিন সকালে তুতানেকাইয়ের বাবা তাকে না পেয়ে পাহাড়ের উপরের কুটিরে ছেলেকে ডাকতে গেল। সেখানে গিয়ে হিনে-মোয়া আর তুতানেকাইকে একসাথে পেল। তাদের খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। তাদের হাসি যেন গ্রীষ্মের সূর্যের মত উজ্জ্বল। হিনে-মোয়ার সাঁতারের কীর্তির কথা, তুতানেকাইয়ের সাথে তার ভালোবাসার কথা দ্রুত লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ল। হিনে-মোয়া যেহেতু তার প্রেমে ও বিশ্বাসে অটল ছিল, তাই তার বাবা মাও শেষ পর্যন্ত তার ভালোবাসাকে মেনে নিল। শীঘ্রই দুই গোত্রের মধ্যে একটা বড় বিয়ের আয়োজন হলো। এতবড় আয়োজন এর আগে কখনো হয় নি।


আজও হিনে-মোয়া আর তুতানেকাইয়ের বংশধরেরা জলের দেবীর প্রজ্ঞার কথা সবাইকে বলে। তিনিই হিনে- মোয়াকে সে রাতে পথ দেখিয়েছিলেন।


[ গল্পটি নিউজিল্যাণ্ডের আদিবাসী মাওরিদের একটি সুপরিচিত লোকগল্প। বর্তমান সংস্করণের ইংরেজী অনুবাদক এমী ফ্রীডম্যান। ]

Featured Writing
Tag Cloud
No tags yet.
bottom of page